বহু বছর বয়ে বেড়াতে হবে আম্পানের ক্ষত
২৭ মে ২০২০ ১৭:১১
ঢাকা: কয়েকদিন আগে উপকূলে আঘাত হেনেছে এই শতকের প্রথম সুপার সাইক্লোন ‘আম্পান’। মূল আঘাতটি ভারতীয় উপকূলে হলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলাতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আক্রান্ত জনপদের সাধারণ মানুষজন বলছেন, এই ঝড়ের ক্ষত সারতে তাদের অনেক বছর লেগে যাবে। এ সময়ে প্রচুর মানুষ তলিয়ে যাবেন দারিদ্র্যসীমায়।
আম্পানের ক্ষতির পরিমাণ জানতে স্থানীয় অনেকের সঙ্গে ঢাকা থেকে মুঠোফোনে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। স্থানীয়রা জানান, আম্পান উপকূলে আঘাত হেনেছে মূলত জোয়ারের সময়। ফলে পনেরো ফুটের চেয়েও উচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব ফসলি জমি ও বাড়িঘর। দমকা বাতাসে অনেকের ঘরদোর ভেঙে পড়ে, পানির তোড়ে ভেসে যায় পথঘাট, আর বিদ্যুতের খুঁটি।
তাই ঈদের আগে ঘটে যাওয়া এমন একটি দুর্যোগতে দারিদ্র্যতায় নেমে যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে বর্ণনা করছেন ভুক্তভোগীরা।
সাতক্ষীরার রশীদ টাকা জমিয়ে যাত্রী পরিবহনের জন্য একটি ভ্যান কিনেছিলেন কিছু দিন আগেই। কিন্তু আম্পানের ঝড়ে সেটি উড়ে গিয়ে নদীতে পড়েছে। এরপর অনেক চেষ্টা করেও তিনি ভ্যানটি খুঁজে পাননি। এর মধ্যে ভেঙে গেছে তার ঘরটিও।
রশীদ বলেন, ‘এ ঝড় বলতে গেলে আমার সবই নিলো। আমাকেও নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু নেয়নি। শরীরে শক্তি আছে, সেটিকে আবার খাটাতে হবে। কাজ করতে হবে। সবকিছু শুরু করতে হবে। না হলে এখন না খেয়ে মরতে হবে।’
রশীদের শক্তি ভালো থাকলেও তার প্রতিবেশী আঞ্জব আলী নিতান্তই বয়স্ক একজন মানুষ। আম্পানের তাণ্ডবে তার বাড়িটি ভেঙে গেছে। তলিয়ে গেছে তার ধানের জমি। ফলে মুঠোফোনে দুটি শব্দ ব্যয় করেই কেঁদে ফেলেন তিনি। শেষ বয়সে বিপদ হয়ে আসা এ দুর্যোগকে নিজের উপর স্রষ্টার পরীক্ষা মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ঘরে খাবারে মুখ তিনজন। একটা ধানের জমি ছিল, সেটিও ঝড়ে তলিয়ে গেল। একটা দিনের জন্য ধানটা কাটতে পারলাম না। এই জমির ধান দিয়া আমাদের সারাবছর চলত। এই বুড়া বয়সে এখন কী করে সংসার চালাব?’
এ সব ব্যক্তিগত ক্ষতির বাইরেও আম্পানে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক রাস্তঘাট, বাঁধ ও বিদ্যুতের খুঁটিও ভেঙে গেছে। ২৬ জেলায় জনপদে নোনা পানি ঢুকে পড়ায় নষ্ট হয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির উর্বরতা। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলের বড় বিনিয়োগ চিংড়ির ঘেরেও লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আম্পানের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন। এই বনের গাছ-গাছালির মধ্যে কেওড়া গাছ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই এলাকায় বন বিভাগের ১০টির বেশি কাঠের জেটি এবং ৩০টির বেশি স্টাফ ব্যারাকের টিনের চাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বনবিভাগের ৬০টির বেশি পুকুরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে।
বরিশালে ৫ জনের মৃত্যু ছাড়াও কাঁচা ঘর-বাড়ি, বেড়িবাঁধ, মৎস্য ও কৃষি বিভাগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে পাবনার ঈশ্বরদীতে লিচু চাষিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার হিসাব অনুযায়ী শুধু লিচুতেই ১৫৪ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া এই জেলায় আম, সবজি এবং চারভাগের এক ভাগ জমির কলা নষ্ট হয়ে গেছে।
চাঁপাইনাববগঞ্জে ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমির আম বাগানের আম ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাশের জেলা নওগাঁতেও ৫০ শতাংশ আম ঝরে পড়ে গেছে।
জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটে চার হাজারের বেশি মাছের ঘের ভেসে গেছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে তিন শতাধিক বাড়িঘর। এ ছাড়া আউশের বীজতলা ভেসে, বেড়িবাঁধ ভেঙে, গাছপালা পড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এভাবে প্রতিটি জেলায় ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও কৃষি মন্ত্রণালয় মিলে আম্পানের প্রাথমিক ক্ষতি ধরেছে ১১০০ কোটি টাকা।
সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, তাদের অধীনে থাকা ১১০০ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০ ব্রিজ কালভার্ট, ২৩৩ টি স্থানীয় সরকার কার্যালয়ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও খুলনায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। ধানের কিছু ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়াও আম, লিচু, কাঁঠাল সব ঝরে পড়েছে। শুধু মাত্র আমের ক্ষতি হয়েছে ১৫০ কোটি টাকার সমান।
রাজশাহীর আমচাষীরা বলছেন প্রায় ২৫ শতাংশ আম নষ্ট হয়ে গেছে। তবে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা ও রাজশাহীতে যেসব আম ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকার কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য সে সব আম কিনে নেবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ১৫০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮৪টি জায়গার বাঁধে ফাটল ধরেছে। ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা লাগবে সেসব মেরামত করতে। সে জন্য ৪ লাখ ব্যাগ প্রয়োজন হবে।
সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ১ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ চিংড়ি ঘেরে পানি বেড়ে ৩৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রাণিসম্পদেও ১৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে কতে সংখ্যক ঘরবাড়ি ভেঙেছে তা এখনো জানা যায়নি।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যশোর। জেলাটিতে ঝড়ের কবলে পড়ে দশজনের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, ঝড়ের একটা ক্ষতি আমরা প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারি। আরেক ধরনের ক্ষতি আছে যেটি বুঝতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এটি শুরুতে প্রকাশ পায় না। আমাদের শত শত মিঠা পানির পুকুর নোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। সুপেয় পানির জন্য মানুষ যে কষ্ট করবে সেটির ক্ষতি নিরুপণ করবেন কীভাবে?
তিনি বলেন, ‘আম্পানের ক্ষত অনেক গভীর, এটি সারতে সময় লাগবে। আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়া এসব মানুষের ভেতর থেকে একটি দরিদ্রশ্রেণী তৈরি হতে পারে।’
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এখানে ১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে পানের বরজ, ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আম ও লিচু এবং ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি ক্ষেত রয়েছে।’ এর প্রায় পুরোটাই ঝড়ের তাণ্ডব মোকাবিলা করলেও সেই ক্ষতি এখনও নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত ঘর নির্মাণ, অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ও পরিচালকরা ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করতে ঈদের ছুটির সময়ও কর্মরত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।