Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় বাধাগ্রস্ত শিশুদের টিকা কার্যক্রম


২৮ মে ২০২০ ১৭:২১

ঢাকা: গাজীপুরের কোনাবাড়িতে থাকেন জাফর আহমেদ (ছদ্মনাম)। পেশায় গণমাধ্যমকর্মী। সন্তানের জন্মের প্রায় দুই মাস সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো টিকা দিতে পারেননি। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করেও জানতে পারেননি, কোথায় গেলে নবজাতকের টিকা দেওয়া যাবে। সন্তানকে সময়মতো টিকা দিতে না পেরে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন জাফর।

প্রায় একই অবস্থা গাজীপুরের কলেজ গেট এলাকায় বসবাসরত রিয়াজ চৌধুরীর পরিবারেরও। সেই পরিবারেও নবজাতক জন্ম নিলেও তার জন্য টিকার ব্যবস্থা করা যায়নি। কোথায় গেলে টিকা দেওয়া যাবে, সেটাও এখনো জানতে পারেননি রিয়াজ।

বিজ্ঞাপন

এ চিত্র কেবল গাজীপুর নয়, বলতে গেলে গোটা দেশেরই। বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে সাধারণ ছুটির কারণে অভিভাবকরা থাকছেন ঘরেই। ফলে অনেক শিশুর টিকা দেওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন অভিভাবকরা। শিশুদের টিকা দেওয়া কর্মসূচি বন্ধ থাকায় বিভিন্ন রকমের সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন তারা। বিশেষ করে হাম-রুবেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ টিকাদান বন্ধ থাকায় বেশি উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে যেসব এলাকা লকডাউন করা হয়েছে, সেসব স্থানে টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়েছে। ঈদের পরে এ কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

এদিকে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ২৪টি দেশে হাম ও রুবেলার টিকাদান কার্যক্রম দেরিতে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ছিল, যেসব দেশে হামের উপদ্রব নেই, সেসব দেশ করোনা মহামারির সময় এই টিকা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকায় এ বছর হাম-রুবেলার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ইপিআইয়ের আওতায় সারাদেশে মা ও শিশুকে ১০টি সংক্রামক রোগের নিয়মিত টিকা দেওয়া হয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বন্ধ থাকলেও অন্যান্যদিন গড়ে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার কেন্দ্রে এ কর্মসূচি চলে। সিটি করপোরেশন, বিভিন্ন হাসপাতাল এবং উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালের স্থায়ী কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের বাইরে সারাদেশে এক লাখ ২০ হাজার টিকাদান কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রগুলো অস্থায়ী এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তিবিশেষের বাসাবাড়িতে অবস্থিত।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ওইসব বাড়ির লোকজনের বহিরাগতদের সমাগমে বিব্রত বোধ করা এবং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় কেন্দ্রগুলো বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ১৮ মার্চ থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ৯ মাস থেকে ১০ বছরের নিচের প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ শিশুকে এক ডোজ করে ‘এমআর টিকা’ দেওয়ার ক্যাম্পেইন পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে হাম ও রুবেলাসহ সব ধরনের টিকাদান কর্মসূচিই স্থগিত করা হয়। আবার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকাদান কর্মসূচি চালু থাকলেও সাধারণ ছুটির কারণে পরিবহন বন্ধ থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষই সন্তানকে নিয়ে যেতে পারছেন না কেন্দ্রে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের প্রাথমিক সক্ষমতা গড়ে ওঠে টিকার মাধ্যমে। টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কারণে দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হয়েছে। তবে বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে এ প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান করা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড-১৯ হলো এক ধরনের ভাইরাস। এই মহামারি কখন সম্পূর্ণভাবে থামবে, তা আসলে কেউ বলতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের টিকার দিকেও নজর রাখতে হবে। কারণ কোভিড-১৯ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করছি সত্য, কিন্তু একইসঙ্গে টিটেনাস, হাম, রুবেলা, ডিপথেরিয়াসহ আরও নানা জটিল রোগের বিরুদ্ধেও কিন্তু আমাদের পরাজিত হওয়া যাবে না। টিকাদানের মাধ্যমেই এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। সেজন্য আমাদের পরামর্শ, টিকাদান চলমান রাখতে হবে।

তিনি বলেন, টিকা দেওয়ার সময় কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন— টিকাদান কেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মীকে অবশ্যই পিপিই পরতে হবে, সেখানে অবশ্যই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে, শিশুকে টিকা দিতে আনতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসতে হ। এক্ষেত্রে হাসপাতালে কমসংখ্যক উপস্থিতি থাকা ভালো। যেসব শিশু মাস্ক পরতে পারে, তারা পরবে। আর নবজাতকদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরানোর প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকরা মাস্ক ও গ্লাভস পড়ে যাবেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সম্ভব হলে শিশুকে নিয়ে একজন যাওয়াই ভালো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এভাবেই আমরা আমাদের হাসপাতালে টিকাদানকে উৎসাহিত করছি। টিকাদান কিন্তু আমাদের হাসপাতালে আমরা বন্ধ করিনি।

লকডাউন এলাকার ক্ষেত্রে টিকাদান দেওয়া সম্ভব না হলে সেই এলাকার বাইরে গিয়ে টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেন ডা. রিজওয়ানুল। তিনি বলেন, যদি বিশেষ কারণে টিকা দেওয়া না যায়, তবে পরবর্তী সময়ে সেটা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। অর্থাৎ কোনো ডোজ মিস হলে পরে সেটি মেইনটেইন করতে হবে। তাহলে খুব একটা বেশি প্রভাব পড়ে না। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই টিকা দিতে পারবে। কিন্তু টিকা মিস করা যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইপিআই প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাওলা বকস চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে টিকাদান কর্মসূচি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এটা সত্য। কারণ অনেক এলাকাতেই লকডাউন ছিল। তবু আমরা চেষ্টা করে গেছি অন্তত স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে সেবা দিয়ে যেতে। বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এই কর্মসূচিকে কিভাবে গতিশীল করা যায়, সে বিষয়েও আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও খুব দ্রুতই আমরা কোথায় গেলে টিকা নেওয়া যাবে সে বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানাতে পারব।

গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে টিকাদান কর্মসূচি একেবারেই বন্ধ রয়েছে— এমন অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছেন মাওলা বকস। ‘এ ক্ষেত্রে খুব দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করছি,’— বলেন তিনি।

জানতে চাইলে গাজীপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহীন সারাবাংলাকে বলেন, লকডাউন পরিস্থিতির কারণে আমাদের টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হয়েছে। লকডাউন এলাকায় টিকাদান কর্মসূচি চালানো যায়নি। এ বিষয়ে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রে আমরা যেসব এলাকায় লকডাউন নেই, সেখানে কর্মসূচি চালানোর চেষ্টা করেছি। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মাদ রহমত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতির কারণে আমরা টিকাদান চালিয়ে নিতে পারিনি। তবে আশা করছি খুব দ্রুতই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন বা যাবতীয় লজিস্টিকের সমর্থন আমাদের দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, ১ জুন থেকে টিকাদান কর্মসূচি ফের চালু করতে পারব।

দেশের অন্যান্য এলাকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলে জানা যায়, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হলেও যেন টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। এছাড়াও জেলা সদর হাসপাতালে ও ভিক্টোরিয়া হাসপাতালেও টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। আমরা এখানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্য।

এদিকে, ইউনিসেফ জানিয়েছে, দেশে ২০১৯ সালের মার্চের তুলনায় ২০২০ সালের মার্চে শিশুদের টিকা নেওয়ার হার ২৫ শতাংশ কমেছে। আর মহামারির সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ কমে যাওয়ার ফলে যে ১০টি দেশে সবচেয়ে বেশি শিশুমৃত্যু ঘটার ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো হলো— বাংলাদেশ, ব্রাজিল, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, উগান্ডা ও তাঞ্জানিয়া। কোভিড-১৯ মহামারীর চাপে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল হতে থাকায় এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় আগামী ছয় মাসে প্রতিদিন অতিরিক্ত ৬,০০০ শিশু মারা যেতে পারে বলেও জানিয়েছে ইউনিসেফ।

সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি তোমো হোযুমি বলেন, মহামারির কারণে স্বাস্থ্যসেবা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে প্রতিরোধযোগ্য ও আরোগ্য লাভ করা সম্ভব— এমন অবস্থা থেকে হাজার হাজার শিশু মারা যেতে পারে। নারী ও শিশুদের জন্য জীবনরক্ষাকারী সেবা সহজলভ্য, নিরাপদ এবং সেবা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে ইউনিসেফ।

করোনা টিকা শিশু স্বাস্থ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর