এক মাসেও প্রকাশ হয়নি নকল এন-৯৫ মাস্ক কাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন
১ জুন ২০২০ ২২:৪৩
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব শুরু হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) থেকে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয় চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও মাস্কসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জামের মধ্যে বড় একটি অংশের এন-৯৫ মাস্ক ছিল নকল। সেগুলো সরবরাহ করেছিল বেসরকারি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপ।
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের পর ওই কমিটি এরই মধ্যে এই নকল এন-৯৫ মাস্ক বিষয়ে প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে জমা দিয়েছে ২৭ এপ্রিল। তবে জমা হওয়ার পর ৩০ দিন পরেও প্রকাশিত হয়নি সে প্রতিবেদন। আর তদন্ত কমিটি রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়াকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না পাওয়াকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা লঙ্ঘন বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: নকল এন-৯৫ মাস্ক: জেএমআই’কে বাঁচাতে প্রকাশ হচ্ছে না প্রতিবেদন?
শুরুর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন ‘অধিকতর যাচাই-বাছাই’ ও ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করতে গিয়েই এখনো প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায়নি।
রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরে ১ মে তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. সাইদূর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত আগেই শেষ হয়েছে। আমরা গত ২৮ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমাও দিয়েছি মন্ত্রণালয়ে। সেটি কেন প্রকাশ পায়নি, সে বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।’
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় ঔষাধাগারের পরিচালক পরিবর্তন
সাইদূর রহমান জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। তবে প্রতিবেদনে কোনো সুপারিশ করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সুপারিশে সরকারি কাজে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কোনো অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে মাস্কের উপরে আমেরিকায় উৎপাদিত এন-৯৫ এর লোগো আসলো সেগুলো নিয়েও উল্লেখ করা হয়েছিল প্রতিবেদনে। একইসঙ্গে যারা এই এন-৯৫ মাস্কের চালান গ্রহণ করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছিল।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশে দেরি হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান জেএমআই’র পক্ষ থেকে বিল নেওয়ার জন্য তড়িঘড়িও করা হয়েছিল এর মধ্যে। কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো বিল দেওয়া হয়নি।
তবে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (অর্থ) ডা. শেখ মো. মঞ্জুর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, জেএমআই’র পক্ষ থেকে কোনো বিল নিতে এখনো আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। এটা তো রাজস্ব অর্থ যেটা মহাপরিচালকের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল। এখন মহাপরিচালকের পক্ষে সিএমএসডি’র ক্রয় কার্যক্রমটা করার জন্য নির্দেশিত হয়েছিল। এখন এ অবস্থায় সিএমএসডি যখন ক্রয়কার্যক্রমটা করবেন তখন তা শেষ করে বিল দাখিল করবেন পরিচালকের (অর্থ) দফতরে। তখন সেখানে যাচাই বাছাই করে মহাপরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে তখন অর্থ ব্যয়ের জন্য বিল দাখিল করবে। যেহেতু আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো বিল আসেনি তাই এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানা নেই। আসার পরে সিদ্ধান্তটা কী হবে তা আসলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে নীতিমালা অনুযায়ী।
এ দিকে জেএমআই’র প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যাবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের অফিস থেকে কোনো বিল এখনো জমা দেওয়ার তথ্য আমার জানা নেই। তদন্ত কমিটির বিষয়ে আমার বক্তব্য এখনো আগের মতো। আমাদের পক্ষ থেকে একটা ভুল হয়েছিল অনিচ্ছাকৃতভাবে। সে বিষয়ে আমরা জবাব দিয়েছি। আমাদের আরএন্ডটি টিমের একটা ভুল হয়েছিল সে বিষয়েও আমরা জানিয়েছি। এক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি আমাদের কাছে যা জানতে চেয়েছে আমরা তার সবকিছুই জানিয়েছি।’
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার প্রায় এক মাস হলেও এখনো প্রকাশিত হয়নি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আসলে কেনো প্রকাশিত হচ্ছে না তা আমি জানি না। যাদের নিয়ন্ত্রণে আছে এই বিষয় এটা তাদেরই দায়িত্ব। যেহেতু আমরা রিপোর্ট দেখি নি তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’
এদিকে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না পাওয়ার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি যখন গঠন করা হয় সেটি মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। কারণ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে শুধুমাত্র দুর্নীতি না, একই সঙ্গে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যারা ফ্রন্টলাইনে থেকে চিকিৎসাসেবায় জড়িত তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষার বিষয়টিও জড়িত ছিল। সেই কারণেই এই তদন্ত কমিটি গঠন মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল। কিছুটা দেরিতে হলেও এই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে যে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে তা হতাশাজনক।’
তিনি বলেন, ‘এই দীর্ঘসূত্রিতা প্রথমত যে ইঙ্গিত দেয় তা হলো সত্যিকার অর্থেই যে কেলেঙ্কারির বিষয়ে অভিযোগ আসছিল তা ঘটেছে। এটা হলো প্রথম বার্তা যার কারণে হয়তো যারা দুর্নীতি করেছেন তারা প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত এই বিলম্বের কারণে তার থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে যে যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো বিষয় এখানে জড়িত কিনা? অথবা যারা এই প্রতিবেদন দেখে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তাদের মধ্যেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারো যোগসাজশ রয়েছিল কিনা? রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ার কারণে এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের দীর্ঘসূত্রিতা বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ পর্যায়ে থেকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দুর্নীতি সহ্য করা হবে বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন তার অবমাননা বলে আমি মনে করি। একইসঙ্গে এই প্রশ্নও ওঠে যে যারা এরসঙ্গে জড়িত তারা কী প্রধানমন্ত্রীর চাইতেও বেশি শক্তিশালী কি না?’
এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে একদিকে যখন দেখা যাচ্ছে তদন্ত ছাড়াই চিকিৎসকদের বদলি ও ওএসডি করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও প্রকাশিত হয় নি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে তাহলে আসলে কাকে রক্ষা করতে এই প্রতিবেদন প্রকাশে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে?
এ অবস্থায় একাধিক চিকিৎসক নেতা সারাবাংলাকে বলছেন, এটা আসলে একধনের দুর্ভাগ্য। দীর্ঘ সময় হয়ে গেলেও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না পাওয়া হতাশাজনক। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ঠিকই বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের বদলি করা হচ্ছে যারা কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন সাহসের সঙ্গে। অথচ কোনো তদন্ত ছাড়াই ওএসডিও করা হচ্ছে। এটা কী আসলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বাঁচানোর প্রয়াস নাকি তাদের সমণ্বয়হীনতার কারণে হচ্ছে সেটা এখন একটা বিশাল প্রশ্ন। একদিকে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন তখন এক মাসেও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট না পাওয়া হতাশাজনক।
উল্লেখ্য, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের জন্য নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের খবর প্রকাশ পেলে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এরপরে ২১ এপ্রিল এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে ২২ মে সিএমএসডি’র পরিচালকের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহকে সেনাবাহিনীতে ফেরাতে তার চাকরি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে ন্যস্ত করা হয়। এই পদে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) আবু হেনা মোরশেদ জামানকে প্রেষণে সিএমএসডি’র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।