Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সামর্থ্যবানরা চিকিৎসা নিতে ঢাকায়, সাধারণ মানুষ ঘুরছে রাস্তায়’


২ জুন ২০২০ ০৮:২৯

ঢাকা: ২৮ মে চট্টগ্রামে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্ত হয় বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর ও তার মা রাজিয়া কবীরের। ডা. হাসান শাহরিয়ার কবিরের মা কিডনিজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন আরও আগে থেকেই। দুই দিন পরপর তাই উনার ডায়ালাইসিস করাতে হতো। চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পরে তার কিডনি ডায়ালাইসিসের কোনো সুবিধা না পেয়ে তাকে ৩০ মে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়।

রাজিয়া কবিরের ডায়ালাইসিসের জন্য জেলা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. শেখ ফজলে রাব্বী চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, সিএসসিআর, ইম্পেরিয়ালসহ ডায়ালাইসিসের সুবিধা থাকা সবগুলো হাসপাতালেই যোগাযোগ করেন। কেউই তাকে ডায়ালাইসিস সেবা দিতে রাজি না হওয়ার রাজিয়া কবিরকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ৩০ মে দুপুর থেকে চট্টগ্রামের জামাল উদ্দিন (ছদ্মনাম) নামে একজন তার বাবা ইকবাল উদ্দিনকে (ছদ্মনাম) নিয়ে যান স্থানীয় ডেল্টা হাসপাতালে। নিয়মিতভাবে কিডনিজনিত সমস্যার কারণে ডায়ালাইসিস করতেন আগে এই হাসপাতালেই। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত ডায়ালাইসিসে ব্যাঘাত ঘটে। শুক্রবার হালকা জ্বর আসে তার। আগেও ডায়ালাইসিস করাতে না পারলে উনার জ্বর আসত। এদিন তিনি চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ডেল্টা হাসপাতালে গেলে ভর্তি দূরের কথা, হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও পর্যবেক্ষণও করা হয়নি তাকে। পরে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পার্ক ভিউ নামে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেও জরুরি বিভাগ থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। পরে জামাল উদ্দিন যোগাযোগ করেন ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে। এই হাসপাতালটিতে কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকলেও পজিটিভ সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো চিকিৎসা দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

জামাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, এই অবস্থায় আব্বাকে নিয়ে ঘুরছি। এমন একটা অবস্থা হয়েছে যেন কোভিড-১৯ সার্টিফিকেট ছাড়া আসলে চিকিৎসা পাওয়া যাবে না কোথাও। টেস্ট করতে কিভাবে যাব এই রোগী নিয়ে এই সময়ে? যাদের সামর্থ্য আছে তারা তো ঢাকা চলে যাচ্ছে, আমরা যাব কোথায়?

নাসিম খান (ছদ্মনাম) নামে আরেকজন ২৯ মে রাতে বাবাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল সেন্টারে গেলেও সেখানে তাকে ইমার্জেন্সিতেও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। একইরকমভাবে বলা হয়েছে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে নিয়ে আসার জন্য।

নাসিম বলেন, বাবাকে চিকিৎসাই দিতে পারছি না। এমন অবস্থায় যদি কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য আরও দৌড়াতে থাকি, তবে চিকিৎসা দেবো কিভাবে? যাদের সামর্থ্য আছে, তারা না হয় ঢাকায় গেল। আমাদের তো এখন এই লকডাউন অবস্থায় রাস্তায় ঘুরে ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।

জানতে চাইলে ডেল্টা হাসপাতালের ডা. ফায়েজ রহমান সারাবাংলাকে বলেন, হ্যাঁ, আমরা আগে রোগীদের ডায়ালাইসিস দিতাম। তবে আমাদের কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য আলাদা কোনো ডায়ালাইসিস ইউনিট নেই। এক্ষেত্রে যেহেতু রোগীর জ্বর আছে, তাই তাকে আমরা ভর্তি নিতে পারব না।

করোনা পরীক্ষা করানো না থাকলে জরুরি বিভাগেও রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা যায় কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. ফায়েজ বলেন, যেহেতু জ্বর আছে, তাই আমরা নিতে পারব না। কোভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে এলে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব।

করোনা পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দেওয়া, পরীক্ষা হওয়া, রেজাল্ট পাওয়া—  এরকম দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে কি? এরকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো চিকিৎসা দিতেই চাই। কিন্তু যদি তার কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়, তবে আমি কি অন্য রোগীদের ঝুঁকির মুখে ফেলব? যেখানে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর নিজের মায়ের ডায়ালাইসিস করাতে না পেরে ঢাকায় নিয়ে গেছেন, সেখানে বোঝেন অবস্থা?

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীরের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. শেখ ফজলে রাব্বী সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য এখনো কোনো ডায়ালাইসিস ইউনিট নেই, এটা সত্য। এ বিষয় নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ হয়েছে অনেক। বর্তমানে আসলে যেসব স্থানে কোভিড-১৯ চিকিৎসা চলছে, সেখানে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য আলাদাভাবে ডায়ালাইসিস ইউনিট করা যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমরা কোভিড-১৯ চিকিৎসা শুরু হতে যাচ্ছে। সেখানে আমরা বলেছি যে অন্তত একটা ডায়ালাইসিস ইউনিট রাখার জন্য। এছাড়া আমাদের আর উপায় নাই।

সিভিল সার্জন আরও বলেন, মূলত চট্টগ্রামে যে সমস্যা হয়, তা হলো এখানে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় আমাদের আলাদা কিছু করার থাকে না। এটা আমাদের জন্য একটা সমস্যা। প্রতিটি হাসপাতালেই আলাদা ব্যবস্থাপনা আছে। আমরা শুধু সমন্বয় করে থাকি, যেটা অন্যান্য জায়গায় সিভিল সার্জন করে থাকেন। তবে বিভাগীয় কমিশনারসহ অন্য সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং হছে। সেখানে সব হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া বিষয়ে যে অভিযোগ, সেটি মূলত স্বাস্থ্য অধিদফতরের বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেখা হয়ে থাকে। তারপরও আমরা একটি বৈঠক করেছি। আশা করছি খুব দ্রুত এই অবস্থার উন্নতি হবে। আমরা একটা কমিটি করেছি। ভবিষ্যতেও মনিটরিং করে যাব।

এদিকে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জানানো হয়, চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মারা গেলে এবং চিকিৎসা সেবায় অবহেলা করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে ভুক্তভোগীদের জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) হটলাইন চালু করেছে। এই হটলাইন নম্বরে অভিযোগ করলেই ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

এ বিষয়ে সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) আবু বকর সিদ্দিক জানান, চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে কেউ মারা গেলে অথবা চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা করলে তথ্য-প্রমাণসহ আমাদের জানালেই আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।

তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগীরা আমাদের হটলাইন নম্বরে (০১৪০০৪০০৪০০, ০১৮৮০৮০৮০৮০) ফোন করে জানালে আমরা কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেব। পুলিশ নগরবাসীর পাশে আছে।

এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী, চট্টগ্রামে বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাসিরের মোবাইলে বারবার কল করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।

অব্যাবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান ও প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারাও কেউ ফোন ধরেননি।

কোভিড-১৯ চিকিৎসা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর