ছিনতাইকারী তৎপর, পুলিশ ‘ব্যস্ত’ অপরাধ আড়ালে
৫ মার্চ ২০১৮ ১১:১০ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ১৯:৪৩
রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
চট্টগ্রাম ব্যুরো : নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকার শুকতারা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক দীপতনু কর গত ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে সতীশ বাবু লেইনের মা বিল্ডিংয়ের সামনে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন। রাস্তার ওপর জমাটবদ্ধ দীপতনুর রক্ত দেখে সেদিন আঁতকে উঠেন পথচারীরা। এই ঘটনায় মামলা করার জন্য কোতয়ালী থানায় গিয়েছিলেন দীপতনুর মা। অভিযোগ, থানা থেকে মামলা না নিয়ে তার মাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
গত ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নগরীর দুই নম্বর গেইট এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফের একটি ট্যাব ও কিছু কাগজপত্র ছিনতাই হয়। খুলশী থানা পুলিশ আরিফের কাছ থেকে একটি ট্যাব হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ করে। অথচ সম্প্রতি নগর গোয়েন্দা পুলিশ একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দলের আস্তানা থেকে ওই ট্যাব উদ্ধার করেছে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তারান্নুম পিয়ার ব্যাগ ছিনতাই হয়। এতে ছিল মোবাইল, এক হাজার টাকা ও আইডি কার্ড। পিয়ার ভাই জোবায়দুর রশিদ গণি থানায় মামলা করার জন্য গেলে ছিনতাইয়ের অভিযোগে লেখা বাক্যটি মুছে দিয়ে পুলিশ ‘যাওয়ার পথে হারিয়ে যায়’ বাক্যটি জুড়ে দেয়। মামলার পরিবর্তে নেওয়া হয় জিডি।
নগরজুড়ে এভাবে প্রতিদিন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছেই তথ্য আছে, নগরীতে কয়েকটি থানা এলাকায় দিনে গড়ে ৪-৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো আড়াল করতে তৎপর নগরীর বেশ কয়েকটি থানা। ছিনতাইয়ের পর ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়ে আরেক দফা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। বাধ্য হচ্ছেন মামলা না করে জিডি করতে।
নগরীর কোতয়ালী, চান্দগাঁও, খুলশী, চকবাজার, হালিশহর থানার বিরুদ্ধে অপরাধ আড়াল করার অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরেশোরে। থানায় গিয়ে প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগীরা ভিড় করছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে।
দীপতনু কর সারাবাংলাকে বলেন, কোতয়ালী থানা যখন মামলা নেয়নি তখন আমি ফেসবুকে ওসি মহসীন সাহেবের (ডিবি পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসীন) সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে কাজ শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন।
ছিনতাইয়ের শিকার মোহাম্মদ আরিফ সারাবাংলাকে বলেন, থানায় গিয়ে বুঝতে পারলাম সেখানে মামলা করে লাভ হবে না। তখন ডিবিতে আসি। কামরুজ্জামান এবং জহির স্যার (দুই পরিদর্শক) মিলে খুলশীতে এক ছিনতাইকারীর আস্তানা থেকে আমার প্যাডটা উদ্ধার করেছেন।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আব্দুল ওয়ারিশ খান সারাবাংলাকে বলেন, আমার জোনের মধ্যে খুলশী ও পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ছিনতাই বেশি হচ্ছে। যাত্রীরা বাস থেকে নামার পর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুই নম্বর গেইট এলাকায় মাদকসেবী কিছু কিশোর ছিনতাইয়ে জড়িত আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে কিছু ছিনতাই হয়। সব ছিনতাইয়ের রিপোর্ট যে থানায় হচ্ছে না, এটা সত্য। তবে আমাদের স্পষ্ট নির্দেশ আছে, ছিনতাই হলে মামলা নিতে হবে। আমরা এটাও বলেছি, থানা মামলা না নিলে সরাসরি ডিসি-এডিসি কিংবা এসি’র কাছে অভিযোগ করার জন্য। আমরাই মামলা রেকর্ডের ব্যবস্থা করব।
সূত্র মতে, সম্প্রতি হালিশহর থানা নিয়ে সিএমপি কমিশনারকে দেওয়া উপ-কমিশনার (পশ্চিম) ফারুকুল হাসানের অভ্যন্তরীণ একটি প্রতিবেদনেও ছিনতাইয়ের মামলা না নেওয়ার সত্যতা পাওয়ার তথ্য এসেছে।
এতে বলা হয়, সম্প্রতি নগরীর হালিশহর আবাসিক এলাকায় বিদেশি এক নাগরিক ছিনতাইকারীদের হাতে আক্রান্ত হলেও হালিশহর থানা মামলা নেয়নি। এজন্য হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানকে শোকজ করার সুপারিশ করেছেন তিনি।
অভ্যন্তরীণ তদন্তের বিষয় সরাসরি স্বীকার না করলেও ফারুকুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, কিছু বিষয় তো সিরিয়াসলি নিতে হবে। ছিনতাইয়ের বিষয়টিও আমরা সিরিয়াসলি নিয়েছি। প্রত্যেক ক্রাইম কনফারেন্সে কমিশনার স্যার এই ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। আমাদের যদি শক্ত অবস্থান না থাকে তাহলে দেখা যাবে উপরে সব ভালো, ভেতরে আসলে ফাঁকা। নদীভাঙনের মতো করে সিএমপির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভেঙে পড়বে।
‘আমার জোনে ডবলমুরিং থানায় যে কয়টা ছিনতাই হয়, পুলিশ জানতে পারলে সবগুলোই রেকর্ড হয়। ক্রাইম কনফারেন্সেও আমার জোনের ছিনতাই নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু অন্য জোনে যখন কোন ছিনতাইয়ের ঘটনা আলোচনায় আসছে না, তাহলে বলতে হবে হয়ত সেখানে কোন ছিনতাই হচ্ছে না অথবা ছিনতাই হলেও রেকর্ড হচ্ছে না’ বলেন ফারুকুল।
তবে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও মামলা না হওয়ার বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা ছিনতাইয়ের শিকার হন তারা নিজেরাই মামলা দিতে চান না। এমন ঘটনা আছে, পুলিশ হাতেনাতে ছিনতাইকারী ধরল অথচ আক্রান্ত ব্যক্তি মামলা করতে রাজি নন। কারণ মামলা করলে ছিনতাইয়ের পর উদ্ধার করা মালামাল পুলিশ আলামত হিসেবে জব্দ করে। এছাড়া কোর্টে যেতে হয়। এসব বিষয়কে ঝামেলা মনে করেন ভুক্তভোগী।’
ছিনতাই প্রতিরোধে রোববার (০৪ মার্চ) থেকে নতুন কৌশলে অভিযান শুরুর কথাও জানিয়েছেন মোস্তাইন। তিনি বলেন, তালিকা অনুযায়ী একজন পুলিশ অফিসারকে দুজন করে ছিনতাইকারীর নাম দিয়েছি। তাদের হয়ত ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করতে হবে অথবা বলতে হবে যে সে জেলে আছে। এ কাজে গাফেলতি প্রমাণ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।
সূত্র মতে, সিএমপির ১৬ থানায় ১০৩ জন ছিনতাইকারীর নাম তালিকায় আছে। দুই বছর আগে করা এই তালিকা আর নতুন করে হালনাগাদ হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, নগরীতে এখন বড় ধরনের ছিনতাই কম হয়। যা হচ্ছে সেগুলো ব্যাগ টেনে নেওয়া কিংবা নির্জন স্থানে হঠাৎ পথরোধ করে মোবাইল-টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। থানাগুলো ছোটখাট এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রতিরোধে যেমন কোন ভূমিকা রাখছে না, তেমনি অপরাধকেও আড়াল করছে মামলা রেকর্ড না করার মাধ্যমে। ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে কয়েকজন ওসিকে বারবার বলা হলেও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না।
নগর গোয়েন্দা পুলিশর উপ-কমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ছিনতাইয়ের শিকার অনেকেই আমাদের কাছে মালামাল উদ্ধারের আবেদন নিয়ে আসেন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তবে এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
সারাবাংলা/আরডি/টিএম