‘বাইরে গিয়ে ত্রাণ চাওয়াটাই শুধু বাকি’
৫ জুন ২০২০ ১০:৩৩
ফেনী: মো. সাহেদ (ছদ্মনাম)। গরিব ঘরের মেধাবী সন্তান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি। সরকারি চাকরি খুঁজতে খুজঁতে বয়স পার। বর্তমানে জেলার সিটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। আর এটা করেই কোনোরকমে পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্ত গত দুই মাস প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নেই। ওই বেতনের ওপরই নির্ভর করে চলতো সংসার। ‘সংসার চলছে না, এমন অভাব আগে কখনো আসেনি। বাইরে গিয়ে ত্রাণ চাওয়াটাই বাকি রয়েছে। কিন্তু সেটাও পারছি না’— বলছিলেন সাহেদ।
শুধু সাহেদ নয়, এরকম পরিস্থিতি এখন ফেনীর নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক শিক্ষক পরিবারের। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সৃষ্ট লকডাউন এবং সরকার ঘোষিত দীর্ঘ ছুটির কারণে গত কয়েক মাস ধরে বেতনভাতা পাচ্ছেন না ফেনীর প্রাইভেট কলেজ ও নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। জেলার ১২টি প্রাইভেট কলেজের আড়াই শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
শিক্ষকরা জানান, পেশায় থাকার কারণে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও নিতে পারছে না তারা। আবার কোনো ধরনের সহায়তার তালিকায়ও তাদের নাম নেই। অস্বচ্ছল শিক্ষক পরিবারের সহায়তায় এখন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি।
বিকন মডেল কলেজের প্রভাষক আবুল খায়ের বলেন, ‘স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সামান্য বেতনে শহরের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। শিক্ষকতা আর টিউশনিতে চলতো সংসার। এখন প্রতিষ্ঠানের বেতন এবং টিউশনি সবই বন্ধ। বাসা ভাড়া ও সংসার খরচের মতো কোনো অর্থই নেই। আমাদের কথা কেউ ভাবে না।’
জেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাইভেট কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মার্চ মাসে অর্ধেক বেতন দিয়েছে। এখনও এপ্রিল মাসের বেতন বাকি। পরিবার নিয়ে কত কষ্টে আছি বুঝাতে পারব না।’
বিকন মডেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম মাছুম বিল্লাহ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি’র টাকা থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়। কিন্ত মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সেজন্য তারা মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতন পাননি। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ফেব্রুয়ারি মাসেরও বেতন পাননি। সামনে আর কতদিন এভাবে চলবে বলা যাচ্ছে না। তাহলে শিক্ষকরা চলবে কিভাবে?’
ফেনী টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মমিনুল হক জানান, স্কুল ও কলেজ বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফি বন্ধ। প্রতিষ্ঠানগুলো গত দুই-তিন মাস ধরে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না। শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্বচ্ছল অভিভাবকদের শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
ফেনী জেলা নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক ফেডারেশন সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো যে দিনই খোলা হোক না কেন, একদিনও না পড়ে শিক্ষার্থীরা বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে না। আবার স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যে সবাই বেতন পরিশোধ করবে ব্যাপারটা তা-ও নয়। কারণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বিভিন্ন পেশাজীবী। তারাও এখন বেকার রয়েছেন। কমপক্ষে আগামী ছয় মাস শিক্ষকরা চরম অভাবে থাকবেন।
ফেনী সিটি কলেজের পরিচালক (প্রশাসন) মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘এরই মধ্যে মাদরাসা ও ও কিন্ডারগার্টেনের জন্য সরকার সহযোগিতা ঘোষণা করেছে। তাহলে প্রাইভেট কলেজগুলো কেন বঞ্চিত হবে? প্রাইভেট কলেজগুলো রেজাল্ট বরাবরই ভালো। আশা করি করোনার দুঃসময়ে প্রাইভেট কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য সরকার সহযোগিতার হাত বাড়াবে।’ এদিকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের ভবন ভাড়া এবং বিদ্যুৎ বিলও পরিশোধ করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
দরবেশেরহাট পাবলিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও ফেনী জজকোর্টের অ্যাডভোকেট এম শাহজাহান সাজু বলেন, ‘ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রাইভেট কলেজগুলোকে দ্রুত এমপিওভুক্ত করা হোক। বর্তমানে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বেতনও কালেকশন করা যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষকরা সীমাহীন কষ্টে আছে।’ তিনি ফেনীর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রাইভেট কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানান।
শিক্ষকদের এমন দুঃসময়ের তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হলে ফেনীর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী সলিম উল্যাহ বলেন, ‘প্রাইভেট কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন যাপনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। আশা করি, তারা এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াবেন।’
করোনাভাইরাস করোনার আঘাত প্রাইভেট কলেজ প্রাইভেট কলেজের শিক্ষক ফেনী বেসরকারি কলেজ