করোনাকালে ডিজিটাল উদ্যোগে ভরসা পাচ্ছেন চুয়াডাঙ্গার কৃষকরা
৬ জুন ২০২০ ০৮:৩২
চুয়াডাঙ্গা: কোন পোকার জন্য কোন কীটনাশক, কোন সময় সেচ দিতে হবে, ফসলের ক্ষেতে কোন সমস্যা হচ্ছে কি না— এসব সমস্যার সমাধান ফসলের ক্ষেতে দাঁড়িয়েই মোবাইল ফোন কল বা মেসেজের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের হানুরবাড়াদি গ্রামের কৃষক স্বপন আলী। তিনি মুখী কচু, শসা, তরমুজ ও ধান মিলিয়ে আট বিঘা জমির আবাদ করেছেন।
একই গ্রামের দলিলউদ্দিন তার হাতের স্মার্টফোন দেখিয়ে বললেন, কৃষি বিষয়ক কয়েকশ ভিডিও সেভ করা আছে। ইউটিউবে নতুন নতুন কৃষিভিত্তিক ভিডিও প্রতিবেদন দেখে কৃষিকাজে অনেক উপকার পাচ্ছেন।
গাড়াবাড়ীয়া গ্রাামের কৃষক আব্দুল কাদের বলছেন, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আমাদের গ্রামে কৃষক সংগঠন ও ডিজিটাল কৃষি পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল কৃষি পাঠাগারে সদর উপজেলা কৃষি অফিসার ৩২ ইঞ্চি এলইডি টিভি দিয়েছেন। সেখানে আমরা পেনড্রাইভ দিয়ে কৃষি বিষয়ক ভিডিও দেখি সবাই। বিভিন্ন টিভি চ্যনেলে কৃষি বিষয়ক সংবাদ দেখি। কৃষি কথা ও বই পুস্তক পড়ি। এটা আমাদের খুব কাজে লাগছে।
পৌর শহরের শিক্ষিত কৃষি উদ্যোক্তা হাফেয আব্দুল কাদের সোহান তার স্মার্টফোন দেখিয়ে বলেন, ‘কৃষি অফিস থেকে আমার মোবাইল ফোনে কয়েকটা অ্যাপস দিয়েছে। সেগুলো দেখে দেখেই বাগানের পরিচর্যা করছি।
স্বপ্ন আলী, দলিলউদ্দিন, আব্দুল কাদের আর হাফেয সোহানই কেবল নয়— স্মার্টফোন, ইউটিউবের মতো বিষয়গুলো এখন চুয়াডাঙ্গার অনেক কৃষকেরই সহায় হয়ে উঠেছে। চাইলেই ফোনকল, মেসেজিং বা অ্যাপ থেকে পেয়ে যাচ্ছেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। সবচেয়ে বড় কথা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের চলমান ঝুঁকির মধ্যে যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সবাইকে, তখন এসব ডিজিটাল সেবার বদৌলতেই কৃষককে ছুটতে হচ্ছে না কৃষি অফিসে, যেতে হচ্ছে না অন্য কারও সংস্পর্শে। অথচ ঠিক ঠিক নিজের প্রয়োজনীয় পরামর্শগুলো পেয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, সরকারি ছুটি যখন চলছিল, তখনো এরকম ডিজিটাল সেবাগুলো অব্যাহত রাখতেই খোলা ছিল চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষি অফিস। কৃষকদের ডিজিটাল সেবায় অভ্যস্ত করার ফলে অফিস খোলা থাকলেও আর নেই আগের মতো কৃষকদের আনাগোনা। ফলে অফিস চালু থাকলেও কর্মকর্তারা সামাজিক দূরত্ব রেখে যেমন কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনি কৃষকদেরও পরামর্শ দিয়ে যেতে পারছেন। আর গতানুগতিক কৃষি পরামর্শ সেবাকে এভাবে ডিজিটাল সেবায় পরিবর্তন করেছেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাসরুর।
জানতে চাইলে তালহা জুবাইর মাসরুর সারাবাংলাকে বলেন, করোনার এই দুঃসময়ে কৃষকদের পরামর্শ সেবা সহজ করা ও মোবাইল ফোনে হটলাইন সেবা চালু করা হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার ফোন নম্বরসহ চারটি নম্বরকে কৃষি সেবা হটলাইন হিসাবে প্রচার করা হয়েছে। কেবল চুয়াডাঙ্গা নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকেরা তাদের সমস্যা নিয়ে এই নম্বরগুলোতে কল করছেন। সরাসরি অথবা এসএমএসের মাধ্যমে কৃষি পরামর্শ সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
কেবল হটলাইনেই সীমাবদ্ধ নেই এই কৃষি কর্মকর্তার উদ্যোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও কৃষি প্রযুক্তি ও পরামর্শ সেবা দিয়ে চলেছেন তিনি। ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার করছেন কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও, যেখানে হাতে-কলমে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়। মাঠের কৃষক থেকে শুরু করে যারা বাড়িতে ছাদবাগান করতে চান, তাদের সবার জন্যই এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে কনটেন্ট।
চুয়াডাঙ্গার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আফরিন বিনতে আজিজ জানান, করোনাভাইরাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উপসহকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাপ্তাহিক মিটিং আয়োজন করছেন নিয়মিত। শুধু তাই নয়, অনেক কৃষকও নিজের সমস্যা বোঝাতে মোবাইলে ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছেন, প্রয়োজনে ভিডিও কল করছেন।
আফরিন জানান চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার রিপোর্ট রিটার্ন, সার মনিটরিং সিস্টেম ও ওয়েদার ফোরকাস্টের সবকিছুই কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্তদের নিয়ে অনলাইন গ্রুপ করা হয়েছে, যেখানে কোনো তথ্য দিলে তা সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তেই। কারও মতামত বা সমস্যা থাকলেও সেগুলো তারা জানিয়ে দিচ্ছেন ওই গ্রুপে।
এদিকে, করোনাকালে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে বাজারসংযোগে সহায়তা ও কৃষিপণ্য পরিবহনের প্রত্যয়নপত্র দিচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিস। কৃষিপণ্য ও সবজির আড়তগুলো খোলা রাখা ও ঢাকাসহ দেশের পাইকারি বাজারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কৃষি পণ্যের পরিবহন ও যাতায়াত অবাধ করা এবং স্থানীয় সবজি বাজারগুলো খোলা রাখা বিষয়েও কাজ করছে।
কৃষি অফিসার তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, করোনার এই দুঃসময়ে যখন সব কল-কারখানা ও অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে, অর্থনীতির শক্তিশালী চাকা প্রায় স্থবির, দেশের কৃষি ও কৃষকই তখন আশার আলো দেখাচ্ছে। এই সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কৃষকের সঙ্গে থেকে, পাশে থেকে তাদের সাহস দেওয়া, কারিগরি পরামর্শ দিয়ে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, কৃষি পণ্যের ন্যয্য মূল্য পাওয়াটা নিশ্চিত করা। কৃষি কর্মকর্তারা সেই কাজগুলো করলে কৃষকরা আত্মবিশ্বাসী হবেন। করোনা পরবর্তী সম্ভাব্য বৈশ্বিক খাদ্য সংকট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কৃষকদের আত্মবিশ্বাসী হয়ে খাদ্য উৎপাদনে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহায়তার এই ডিজিটাল উদ্যোগগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে— এ প্রত্যাশা করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চুয়াডাঙ্গা ডিজিটাল সেবা নভেল করোনাভাইরাস