৬ মাসেও শেষ হয়নি টেন্ডার প্রক্রিয়া, মশার ওষুধ সংকটে ডিএসসিসি
৬ জুন ২০২০ ১৮:৫১
ঢাকা: আমদানিকৃত মশার ওষুধ ফরমুলেশনের (মিশ্রণ) জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দুই দফা টেন্ডার আহ্বানের পর কেটে গেছে ছয়মাস। কিন্তু টেন্ডারে উপযুক্ত দরদাতা কোনো প্রতিষ্ঠান না পেয়ে সেবা সংস্থা ডিএসসিসি মশা মারার ওষুধ প্রস্তুত করতে পারেনি। এতে সংস্থাটিতে ক্রমেই মশার ওষুধের সংকট প্রকট হচ্ছে। এর ফলে গত ১ মাসের অধিক সময় ধরে ডিএসসিসিতে উড়ন্ত মশা নিধন কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে।
তবে এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কাছে মশার ওষুধ ধার চেয়েছে ডিএসসিসি। গত সপ্তাহে ৫০ হাজার লিটার প্রস্তুতকৃত ওষুধ ধার চেয়ে চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে ডিএনসিসি ২৫ হাজার লিটার ওষুধ দেয়ার সম্মতি জানিয়ে ফাইল অনুমোদন করেছে। দুই সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ভারত থেকে আমাদানিকৃত মশার অ্যাডাল্টি সাইটিং ওষুধ ম্যালাথিউন ৫% ফরমুলেশনের (মিশ্রণ) জন্য চলতি বছরের ১ জানুয়ারি টেন্ডার আহ্বান করে ডিএসসিসি। মূলত ম্যালাথিউন ৫% ওষুধটি সরাসরি ব্যবহার উপযোগী নয়। তাই এ ওষুধটির সঙ্গে ৯৫ শতাংশ ডিজেল ও ২৫ থেকে ৫০ এমএল সাইট্রোনেলা নামের একটি ভেষজ তেল মিশ্রণ করে উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ প্রস্তুত করতে হয়। আর এ প্রস্তুত প্রক্রিয়াটি ডিএসসিসি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে করতে টেন্ডার আহ্বান করেছিল।
কিন্তু ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টি সাইটিং ওষুধ প্রস্তুতের জন্য ডিএসসিসির ডাকা টেন্ডারে প্রথম দফায় অংশ নেয় তিনটি প্রতিষ্ঠান। টেন্ডারে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতি লিটার ১৭২ টাকা দরে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড। ১৮৫ টাকা দরে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড এবং ১৯৫ টাকা দরে তৃতীয় অবস্থানে ছিল জাহিন কনস্ট্রাকশন। কিন্তু গত বছর মানহীন ওষুধ সরবরাহের অভিযোগ থাকায় প্রথম দরদাতা প্রতিষ্ঠান দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দেয়নি ডিএসসিসি। অপর দুটি প্রতিষ্ঠানেরও দর প্রত্যাশিত ছিল না বিধায় কাউকে কার্যাদেশ না দিয়ে পুনঃটেন্ডার আহ্বান করে ডিএসসিসি।
কিন্তু ১৮৫ টাকা দরে প্রথম দফায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড ১৫৫ টাকা দরে দ্বিতীয় দফায় পুনঃটেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে অংশ নেয়। আবার প্রথম দফায় ১৭২ টাকা দরে সর্বনিম্মে থাকা দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট দর দেয় ১৬৩ টাকায়। তৃতীয় অবস্থান থাকা মেসার্স নোকন লিমিটেড দর দেয় ১৮৩ টাকা। আর মেসার্স মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান চতুর্থ অবস্থান থেকে দর দেয় ১৮৯ টাকা।
কিন্তু এবারও সর্বনিম্ন দরদাতা নিয়ে বিপাকে পড়ে ডিএসসিসি। দ্বিতীয় দফায় পনঃদরপত্রে অংশ নেওয়া সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দিতে ফাইল প্রস্তুত করে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে মানহীন ওষুধ সরবরাহের অভিযোগ ওঠা দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে জানতে পেরে ফাইল অনুমোদন করেননি সাঈদ খোকন। তবে প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমোদন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে নতুন মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ওষুধের গুনগত মান যাচাই-বাছাই করেছেন এবং ওই প্রতিষ্ঠানের সাভারে অবস্থিত কারখানা পরিদর্শন করেছেন বলে নিশ্চিত করেছে ডিএসসিসির একটি সূত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাঈদ খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দরপত্রে প্রতিষ্ঠানটি অংশ নিলেও সিন্ডিকেটের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। তাই অনুমোদন দিইনি।’
তবে এ বিষয়ে নতুন মেয়র তাপসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার কোনো সাড়া মেলেনি।
এদিকে ডিএসসিসির ক্রয় ও ভান্ডার বিভাগের একটি সূত্র জানায়, টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ার আগেই উড়ন্ত মশা মারার ওষুধের সংকটে পড়ে সংস্থাটি। তাই ডিএনসিসিকে ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং প্রথম ধাপে সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়া মেসার্স মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ১ লাখ লিটার ওষুধ দেওয়ার জন্য মৌখিকভাবে অনুরোধ করে ডিএসসিসি। তাই প্রতিষ্ঠানটি ডিএসসিসিকে ইতোমধ্যে ৬০ হাজার লিটার ওষুধ ফরমুলেশন (মিশ্রণ) করে দিয়েছে। সে ওষুধ ইতোমধ্যে ব্যবহার করে শেষও করে ফেলেছে ডিএসসিসি। কিন্তু বিনা টেন্ডারে নেওয়া সেই ওষুধের বিল এখনো পরিশোধ করেনি ডিএসসিসি।
সূত্র আরও জানায়, গত বছর নভেম্বরে ডিএসসিসির উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ শেষ হয়ে গেলে ডিএনসিসি থেকে ২০ হাজার লিটার ধার নিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত মশার নিধনের কার্যক্রম চালায়। কিন্তু পরে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে মেসার্স মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে বিনা কার্যাদেশে ৬০ হাজার লিটার ওষুধ নেয় ডিএসসিসি। কিন্তু সে ওষুধ শেষ হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটিকে টাকা পরিশোধ না করায় আর ওষুধ দিতে সম্মতি দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১৮ মে সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে দুই সিটির নবনিযুক্ত মেয়রদের সঙ্গে বৈঠকে ডিএসসিসির ওষুধ সংকটের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন মেয়র তাপস। পরে বৈঠকে ডিএসসিসির আপদকালীন সময়ে ওষুধ ধার দেয়ার জন্য ডিএনসিসির প্রতি অনুরোধ করেন মন্ত্রী। বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে এ তথ্য।
ঈদের পর অর্থাৎ গত সপ্তাহের শেষের দিকে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার লিটার প্রস্তুতকৃত ওষুধ ধার চেয়ে লিখিত আবেদন করে ডিএসসিসি। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ হাজার লিটার ওষুধ দেয়ার জন্য অনুমতি দিয়েছে ডিএনসিসি।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহ মো. ইমদাদুল হক এবং প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনালেল শরীফ আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি।
তবে এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের কাছে ৫০ হাজার লিটার ওষুধ ধার চেয়ে ডিএসসিসি চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে আমাদের মেয়র মহোদয় প্রথম ধাপে ২৫ হাজার লিটার ওষুধ দিতে অনুমতি দিয়েছেন। বাকি ২৫ হাজার লিটারও পরবর্তীতে দেওয়া হবে। তবে তারা আমাদেরকে আবার এ ওষুধ ফেরত দেবেন শর্তে দেওয়া হচ্ছে এ ওষুধ।
তিনি বলেন, আমাদেরও তো ওষুধের প্রয়োজন। আমরা তো অন্তত তিনমাসের প্রস্তুতি নিয়ে ওষুধ সংরক্ষণ করি। কিন্তু তারা যদি যথাসময়ে ওষুধ প্রস্তুত না করে তখন তো আমরাও সমস্যায় পড়ে যাব। কারণ তারা এর আগেও ২০ হাজার লিটার নিয়েছিল। সেগুলো ফেরত দেয়ার আগেই আরও ৫০ হাজার চেয়েছে। যদিও আমরা ওষুধ দিতে অপরাগ নই। আমরাও চাই একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে। তবে তাদের দ্রুত ওষুধ প্রস্তুত করা উচিত মনে করি।