Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মে মাসের পূর্ণ বেতন পাচ্ছেন, তবু ছাঁটাই আতঙ্কে পোশাক শ্রমিকরা


১০ জুন ২০২০ ১২:৩৫

ঢাকা: দেশের পোশাক খাতের বড় বড় কিছু কারখানায় শ্রমিকরা মে মাসের বেতন পেতে শুরু করেছেন। এপ্রিল মাসে ৬০ শতাংশ বেতন পেলেও এবার তারা শতভাগ বেতন পাচ্ছেন। তবে অনেক কারখানাতেই শ্রমিকদের মধ্যেই কাজ করছে ছাঁটাই আতঙ্ক। ন্যায্য পাওনা আদায়ে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিককে প্রতিদিনই নামতে হচ্ছে রাস্তায়। শ্রমিক, মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব মিলিয়ে শ্রমিকরা ভালো নেই। এদিকে, ছাঁটাই বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পোশাক মালিকদের সংগঠনগুলোকে চিঠি দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর।

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুরের একটি কারখানার শ্রমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোমবার (৮ জুন) বিকাশে বেতন পেয়েছি। এবার পুরা বেতন পেয়েছি। আমার মতো সবাই শতভাগ বেতন পেয়েছেন।’

ছাঁটাই নিয়ে কারখানায় কোনো অলোচনা হয় কি না— জানতে চাইলে ওই শ্রমিক বলেন, ‘কারখানা ভেতরে কোনো আলোচনা হয় না। তবে বাইরে সবার মধ্যেই কম-বেশি আতঙ্ক কাজ করে— না জানি কখন চাকরি চলে যায়।’

সাভারের একটি কারখানার শ্রমিক জানান, ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে তাদের কারখানায় আন্দোলন হয়েছিল। পরে ঈদের দিন গ্রামে চলে যান। এখনো কাজে ফেরেননি। কারণ শ্রমিকরা ভাঙচুর চালানোর পর ওই কারখানায় আর কাজ শুরু হয়নি। ফলে বাধ্যতামূলকাভবে তিনি এখন বেকার হয়ে পড়েছেন।

রাজধানীর ড্রাগন সোয়েটারের এক শ্রমিক জানান, সম্প্রতি ঢাকা থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ন্যায্য পাওনা দেওয়া হয়নি। ফলে তারা এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। স্মারকলিপি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পোশাক শ্রমিকদের মে মাসের বেতন দেওয়ার জন্য ২ হাজার ৪৪টি কারখানাকে ৪৭টি ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ছাড় করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে ৭ তারিখ থেকেই বেতন দেওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।

বেতনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএমইএ’র পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কারখানায় মে মাসের বেতন নিয়ে এখনো কোন সমস্যা হয়নি। আর বেতন দেওয়ার প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে। বেশকিছু কারখানায় এরই মধ্যে বেতন দেওয়া শেষও হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ’র পরিচালক ফজলে শামীম এহসান সারাবাংলাকে বলেন, মে মাসের বেতন দেওয়া শুরু হয়েছে। শ্রমিকরা এবার পুরো মাস কাজ করেছে, তাই তারা পূর্ণ বেতনই পাচ্ছে। আগের মাসে কম কাজ করেছিল, তাই কম বেতন পেয়েছিল। তারপরও তারা এপ্রিল মাসে বেতন পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, আমরা যারা ঋণের টাকায় বেতন দিচ্ছি, তারা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের জটিলতায় সময়মতো বেতন দিতে পারছি না। সাধারণত আমরা ৭ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে বেতন দিয়ে দিই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন থাকা সত্ত্বেও নানা জটিলতায় সময়মতো বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। আমি লোন নিচ্ছি, কিন্তু আমার শ্রমিক কেন কষ্ট করবে?

জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ঈদের আগে এপ্রিল মাসের বেতন ও বোনাস অনেক কোম্পানিতেই বকেয়া ছিল। ঈদের পর কিছু কারখানায় এপ্রিল মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। আর মে মাসের বেতন ৭ তারিখ থেকে দেওয়া শুরু হয়েছে। দুয়েকটি কারখানায় হয়তো মে মাসের বেতন হয়েছে। সব জায়গায় এখনো মে মাসের বেতন দেওয়া শুরু হয়নি। এর মধ্যে এখনো ছাঁটাই অব্যাহত আছে।

এই শ্রমিক নেতা বলেন, বিজিএমইএ সভাপতি নিজেই ছাঁটাইয়ের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। তারা বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে এলেও ছাঁটাই একেবারে বন্ধ হয়নি। সরকার যদি প্রথম থেকে কঠোর হতো, বলত আমরা ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছি, তোমরা কোনোভাবে শ্রমিকের সঙ্গে অন্যয্য কিছু করতে পারবে না, তাহলে এ পরিস্থিতি ঘটত না। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন হচ্ছে। করোনার মধ্যেও আমরা যথেষ্ট মিটিং-মিছিল করেছি। কেবল চাপ প্রয়োগ করলেই মালিকরা তার অবস্থান থেকে সরে আসছেন। মালিকরা শুধু মুনাফার কথা ভাবছেন, শ্রমিকরা যে সংকটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন, সেদিকে ভাবনা নেই। এখন সরকার যদি মালিকের পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়, তাহলে শ্রমিকরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবে।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সারাবাংলাকে বলেন, মালিকরা নিজেদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপক্ষিত হচ্ছে। এখনো বিভিন্ন কারখানায় ছাঁটাই হচ্ছে। মালিকরা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিলেও শ্রমিকরা এখন ছাঁটাই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সবমিলিয়ে শ্রমিকরা ভালো নেই।

তিনি বলেন, যেসব কারখানার মালিকরা এখনো এপ্রিল মাসের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করেননি, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কিংবা বিক্রি করে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করা উচিত। এই শ্রমিক নেতা আরও বলেন, মে মাসের বেতন দেওয়া এখনো শুরু হয়নি। কিছু বড় বড় ফ্যাক্টরিতে বেতন দেওয়া হয়েছে। আর শ্রমিকরা এই মাসে পূর্ণাঙ্গ বেতন পাচ্ছে।

বিজিএমইএমইএ পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম বলেন, আমাদের এখানে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ছাঁটাই। ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। বড় কারখানাগুলো আমাদের জানায়, সে তথ্যগুলো আমাদের কাছে আসে। কিন্তু অনেক ছোট ছোট কারখানা চুপিসারে ছাঁটাই করে থাকে।

ছাঁটাই প্রসঙ্গে বিকেএমইএ পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, ছাঁটাই-নিয়োগ এগুলো কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেখতে হবে আইন মেনে ছাঁটাই হচ্ছেনা কি না। শুধু যে ছাঁটাই হচ্ছে তা নয়, অনেক কারখানায় এখন নিয়োগও হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, শ্রমিকদের মে মাসের বেতন দেওয়া হচ্ছে। আমার কারখানায় প্রায় ৫০ শতাংশ শ্রমিকের বেতন হয়ে গেছে। কিন্তু প্রণোদনার অর্থে বেতন দিতে একটু সময় লাগে। টাকাটা প্রথমে আমার অ্যাকাউন্টে আসে। পরে আমি ব্যাংকে পাঠাই। তারা শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পোস্টিং করে।

ছাঁটাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিজিএমই সভাপতি রুবানা হক কিন্তু ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেননি। তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। বৈশ্বিক অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

সালাম মুর্শেদী আরও বলেন, পোশাক শিল্পে সবই স্বাভাবিকভাবে চলছে। শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। করোনা পরীক্ষার জন্য আমরা ল্যাব স্থাপন করেছি। মোট পাঁচটি ল্যাব স্থাপন হচ্ছে। শ্রমিকদের জন্য আমরা আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করার চেষ্টা করছি। এগুলো কিন্তু শ্রমিকদের ভালোবেসে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই।

পোশাক কারখানার এই মালিক আরও বলেন, আমাদের শ্রমিকরা কিন্তু অভিজ্ঞ। তাদের ধরে রাখা ও কাজ পাওয়াটাই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ। আমাদের আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তবে প্রণোদনার স্বাদ কিন্তু শুধু শ্রমিকরাই পেয়েছেন, কোনো কর্মচারীকে কিন্তু এই অর্থে বেতন দেওয়া যায়নি। কোনো মালিকও প্রণোদনার বিন্দুমাত্র স্বাদ পাননি।

এদিকে, পোশাক খাতের শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিজিএমইএকে চিঠি দিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই)। রোববার (৭ জুন) প্রতিষ্ঠানটি এই চিঠি পাঠায়।

চিঠিতে বলা হয়, ঈদের পর পোশাকশিল্প মালিকেরা শ্রমিক ছাঁটাই করছেন। অধিদফতরের ২৩টি উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ঈদের পর জানানো হয়— ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের ৬৭টি কারখানার ১৭ হাজার ৫৭৯ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এর মধ্যে টঙ্গীর তানাজ ফ্যাশনস ও ভিয়ালাটেক্স গার্মেন্টসের ২ হাজার ৪৫০ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন।

চিঠিতে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। চিঠির অনুলিপি পোশাক মালিকদের অপর সংগঠন বিকেএমইএ, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমইএ’র পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দফতরে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ছাঁটাই প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হকের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছে।

করোনা করোনাভাইরাস গার্মেন্টস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর