আমনে সাফল্য ধরে রাখতে চায় সরকার, নজর রবি শস্যেও
১৩ জুন ২০২০ ১২:২৯
ঢাকা: গত বছরের আমন চাষের সফলতা এবারও ধরে রাখতে চায় সরকার। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের অভিঘাতের পর খাদ্য সংকট যেন কোনোভাবে মাথাচারা দিয়ে না উঠতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতেই আসন্ন আমন মৌসুমকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর এর জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় দ্রুত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের আমন ধান কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করার উদ্যোগও নিচ্ছে।
এদিকে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেলেও খাদ্য উৎপাদন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী রবি মৌসুমেও তাই কৃষকদের জন্য যথেষ্ট সহায়তা থাকছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে সারাদেশে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৫৪ লাখ টন চাল। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবার আমন ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কম ফলনশীল জাতের আবাদ কমিয়ে আধুনিক অথবা উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের আবাদ সম্প্রসারণ করা হবে। একইসঙ্গে হাইব্রিড জাতের আবাদের এলাকা বাড়ানো হবে। সেজন্য উন্নত জাতের বীজ, সুষম সারের নিশ্চয়তা, পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা, সেচের খরচ কমিয়ে আনাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা কৃষকদের বীজে ভর্তুকি দিয়েছি প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে। এতে আমন মৌসুমে সরকারের খরচ হবে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
কৃষি সচিব আরও বলেন, আমরা গত বছর আমন ধানে বাম্পার ফলন পেয়েছি। সেই সাফল্য আমরা এবারও ধরে রাখতে চাই। আমরা বিএডিসির গবেষণার ফসল কাজে লাগাতে চাই। একইসঙ্গে সনাতন পদ্ধতি থেকে কৃষিকে আরও আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে চাই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) হাইব্রিড ধান-২ নামে পরিচিত একটি জাতের ধান নিয়ে চার বছর ধরে গবেষণা করেছে। আর তাতে সফলতাও এসেছে। গবেষকরা বলছেন, এই ধান আবাদ করা গেলে কম সময়ে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। সময়ের হিসাবে ১৪০ থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যেই পরিপক্ক হয় এই ধান, যা অন্যান্য সাধারণ আমন ধানের চেয়ে প্রায় একমাস কম সময় নেয়। তাই আসছে বর্ষা মৌসুমে আমন চাষে কৃষকদের এ জাতের ধানের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চায় কৃষি মন্ত্রণালয়।
এদিকে, নতুন উইন-২০৭ জাতের ধানেও ফলন ভালো হয়। এই জাতের ধান চাষ করলে প্রতি হেক্টরে সাত টন ধান পাওয়া সম্ভব। এই হিসাবে কৃষকেরা প্রতি বিঘায় আমন আবাদ করে ২৫ থেকে ২৭ মণ পর্যন্ত ধান পাবেন। সাধারণ জাতের আমন ধানে প্রতি বিঘায় ফলন মিলছে সর্বোচ্চ ২০ মণ।
আধুনিক এসব জাতের আবাদ বাড়াতে পারলে দেশে আমনের ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এতে করে বাজারে চালের সরবরাহ নিশ্চিত করাই কেবল নয়, কম সময়ের জাত আবাদের কারণে কৃষকরাও অল্প সময়ে তাদের পুঁজি তুলে নিতে পারবেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা এসেছে। এ অবস্থায় করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সব ধরনের ফল-ফসলের আবাদ বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
এর অংশ হিসেবে কিছুদিন বাদেই শুরু হতে যাওয়া আমন মৌসুম সামনে রেখে প্রতি কেজি বীজে ১০ টাকা করে ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত চিঠি সংশ্লিষ্ট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ভর্তুকি বাবদ সরকারের খরচ হবে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৪ হাজার ৮২০ টাকা। শুক্রবার (১২ জুন) বাজেট পরবর্তী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও এই ভর্তুকির তথ্য তুলে ধরেন। কেবল আমন ধান নয়, পরবর্তী ফসলগুলো চাষের ক্ষেত্রেও সরকার সুবিধা দেবে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, আগামী মৌসুমের জন্য আমার আমন বীজ দিচ্ছি কৃষকদের, সার দিচ্ছি। আউশের বীজ-সারও বিনামূল্যে দিয়েছি। এখন আগামী রবি মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি চলছে। আমরা চাষিদের উপকরণ দেবো, বীজ ও সার দেবো, প্রযুক্তিও দেবো। করোনা ও আম্পানের ক্ষতি যেন তারা পুষিয়ে নিতে পারে, তার জন্য আমরা সার্বিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ বিষয়ে অর্থের সমস্যা হবে না। পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়া আছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ওপরে রয়েছে করোনাকালীন লকডাউন। এ পরিস্থিতিতে পৃথিবীজুড়েই কৃষিপণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশের অনেক এলাকাতেই করোনার কারণে এবার কুমড়ো, টমেটো খেতেই পচেছে। এ পরিস্থিতিতে উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের আবাদে সব ধরনেরর সহায়তার উদ্যোগ যেমন নেওয়া হচ্ছে, তেমনি কৃষি বিপণন নিয়েও কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, আমন আবাদের জমি বাড়ানোর সুযোগ নেই। তবে উন্নতমানের জাত ও মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ এবং গবেষণা পর্যায়ে বিভিন্ন জাতের ধান আবাদ করা যায়। এছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যেসব জেলায় বছরে একটি ফসল হয়, সেসব স্থানে কিভাবে সারাবছর বিভিন্ন ফসল ফলানো যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। গুরুত্ব দেওয়া হবে রবি শষ্যের ওপরও।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে কৃষি খাতে সরকারের গুরুত্বের বিষয়টি বারবার তুলে ধরেন কৃষিমন্ত্রী। এ সময় আমান আবাদের পাশাপাশি করোনা ও আম্পান ঘিরে উপকূলীয় এলাকায় চাষাবাদের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসে। মন্ত্রী বলেন, উপকূলীয় প্রায় দুই মিলিয়ন হেক্টর জমিতে আগে বছরে কেবল একটি ফসল হতো। আমাদের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এখন লবণসহিষ্ণু অনেক ফসলের জাতই উদ্ভাবন করেছেন। এসব এলাকাতেও এখন তরমুজ, মুগ ডালের মতো ফল-ফসল হচ্ছে, যা আগে কখনো চিন্তাই করা যেত না। আমরা আসছে মৌসুমেও তাদের জন্য যা যা সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন, দেবো।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে টালমাটাল হয়ে পড়া বিশ্বে খাদ্য সংকট একটি বড় ইস্যু হয় দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পরিস্থিতিতে তাই খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে সরকার। কয়েকদিন আগে কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে কৃষিমন্ত্রীও এ বিষয়টিতেই জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদনের যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি রয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। আমন ও রবি মৌসুমে বীজ-সার, সেচে যেন কোনো সমস্যা-সংকট না হয়, তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি।
আমন কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)