মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যু রাজনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি: আ.লীগ
১৪ জুন ২০২০ ১৮:১০
ঢাকা: জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সুযোগ্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেকমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নামাজে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। রোববার (১৪ জুন) সকাল সাড়ে দশটার দিকে করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে রাজধানীর বনানী কবরস্থান মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে এই বর্ষীয়ান নেতাকে দাফন করা হয়। এসময় সংগ্রামী এ নেতাকে চিরবিদায় জানায় আওয়ামী লীগ পরিবারের নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, সেটা পূরণ হবার নয়- এমনটাই মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।
নাসিমের জানাজায় উপস্থিত ছিলেন তার দুই ছেলে তানভীর শাকিল জয় এবং তন্ময় মনসুরসহ পরিবারের একান্ত আপনজনরা। দাফনের পর মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করেন পরিবার ও নিকটাত্মীয়রা। এর আগে ধানমন্ডির সোবহানবাগ মসজিদেও মোহাম্মদ নাসিমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
বনানী কবরস্থান মসজিদের জানাজায় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আব্দুল মতিন খসরু, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান, সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনসহ ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি জাসদ, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্র পার্টিসহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি ও নেতারা। জানাজায় আরও শরিক হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।
মরহুমের পরিবারের পক্ষে নামাজে জানাজার আগে পিতার জন্য দোয়া কামনা করেন মোহাম্মদ নাসিমের বড় ছেলে তানভীর শাকিল জয়। জানাজার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষে চৌকষ একটি দল গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এরপর নাসিমের কফিনে প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সামরিক সচিব শ্রদ্ধা জানান। এরপর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। একে একে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর-দক্ষিণ, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা ও ঢাকা সিটি উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
এ সময় মোহাম্মদ নাসিমের বড় ছেলে সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে আমার পিতার জন্য দোয়া চাই। আপনারা সকলেই দোয়া করবেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে যেন জান্নাতবাসী করেন। আমি আমার পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি, যিনি আমাদের পরিবারের অভিভাবক হিসেবে আমার বাবা যেদিন থেকে অসুস্থ প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর নিয়েছেন। আমার বাবার সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও কৃতজ্ঞতা জানাই আওয়ামী লীগের সকল কেন্দ্রীয় নেতাদের যাদের সবাই সার্বক্ষণিক আমাদের খোঁজখবর রেখেছেন, সাহস যুগিয়েছেন তাদের প্রতি। কৃতজ্ঞতা জানাই আওয়ামী পরিবারের সকল সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি।’
দেশবাসীর কাছে বাবার জন্য দোয়া কামনা করে তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘আমার বাবা সারাজীবন এই মাটি ও মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে আমার দাদার মতো মানুষের সেবা করেছেন। আমি আমার প্রিয় সিরাজগঞ্জের লক্ষ মানুষের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাই। আপনারা অনেকে অনুরোধ করেছিলেন, বাবাকে সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের এই দুঃখ সারাজীবন থাকবে। এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আমরা শুধুমাত্র মানুষের কথা চিন্তা করে বাবার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারলাম না।’
জাতীয় সংসদের সাবেক এই এমপি বলেন, ‘আমার সিরাজগঞ্জ ও উত্তরবঙ্গের কোটি কোটি মানুষের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আমার বাবার জানাজায় যারা আসতে পারলেন না, আমি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আপনারা সকলে আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার বাবা হয়তো অনেক সময় ভুল করেছেন; সেজন্য আপনাদের সকলের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাই। আপনারা তার সব ভুল-ক্রুটি মাফ করে দেবেন।’
এদিকে জানাজার শুরুতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর নানক মোহাম্মদ নাসিমের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেন। নানক বলেন, ‘একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করার পর আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত কান্ডারী শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকেও হত্যা করা হয়। তারপর এই বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে ভোট ও ভাতের আন্দোলন হয়েছে সেই আন্দোলনে মোহাম্মদ নাসিম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় নাসিম ভাই আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গিয়েছেন। মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত নাসিম ভাই আর সেই হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে আমাদের সামনে আর কখনো কথা বলবেন না।’
এছাড়াও মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দেশে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পক্ষে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার এই ভূমিকার কথা, অবদানের কথা জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আজ সারাবিশ্বে যখন এই করোনাভাইরাস সমস্যা; সেই মুহূর্তে আমাদের একজন সাহসী নেতার অকাল মৃত্যুতে আমরা আওয়ামী লীগ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নাগরিক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমরা হারিয়েছি আমাদের আপনজন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ ও জাতি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।’
বাহাউদ্দিন নাছিম আরও বলেন, ‘তিনি তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক বারবার কারাবরণ করেছেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী রাজনৈতিক পরিবারের একজন সাহসী যোদ্ধা। এই কর্মীবান্ধব ও জনবান্ধব নেতার মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, এটা পূরণ হবার নয়।’
এর আগে ১ জুন রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। পরে রাতে তার করোনাভাইরাস পজেটিভ আসে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত অবস্থায় গত ৫ জুন ভোরে মারাত্মক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। পরে জরুরিভাবে তার মস্তিষ্কে অপারেশন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উচ্চ পর্যায়ের একটি মেডিক্যাল বোর্ড মোহাম্মদ নাসিমকে সুস্থ করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পরে দুবার করোনা টেস্টে নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শনিবার চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েন মোহাম্মদ নাসিম।
মোহাম্মদ নাসিমের চিরবিদায়ে থেমে গেল রাজনৈতিক অঙ্গনের এক কীর্তিমান নেতার পথচলা। শনিবার তার জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে পিতার মতোই সাহসী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল, ত্যাগী ও রাজপথের এক সাহসী যোদ্ধার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনেরও ইতি ঘটল।