করোনাকালে বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন
১৪ জুন ২০২০ ২০:৩৪
ঢাকা: করোনাভাইরাসে সাধারণ ছুটির মধ্যেও নারীর ওপর নির্যাতন ও সহিংসতা বেড়েছে বলে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপে উঠে এসেছে, এপ্রিলে ১৭ হাজার নারী-শিশুর সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পেরেছেন, ৪ হাজার নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আর মে মাসে ৫৩ হাজার নারী ও শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৩ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। অর্থাৎ দুই মাসেই জরিপে অংশ নেওয়া নারী-শিশুদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
শনিবার (১৩ জুন) সন্ধ্যায় অনলাইনে সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে ‘নারী নির্যাতন ও চলমান পরিস্থিতি’ বিষয়ক আলোচনায় বক্তাদের বক্তব্যে এ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। তারা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, আমরা মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে ১৮ বছর ধরে কাজ করছি। এই করোনাকালের এপ্রিল মাসেও আমরা জরিপ করেছিলাম। ১৭ হাজার নারী ও শিশুর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এর মধ্যে ৪ হাজার নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। মে মাসে ৫৩ হাজার নারী ও শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৩ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার। এর মধ্যে ১১ হাজার তিনশ নারী ও ২ হাজার শিশু।
শাহীন আনাম বলেন, এসব নির্যাতনের মধ্যে পারিবারিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন রয়েছে। আমরা ৫০টির বেশি জেলায় এই জরিপ করেছি। তাতে দেখছি, এই করোনাকালেও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। সেইসঙ্গে এই সময়ে বেড়েছে বাল্যবিয়ে। করোনাভাইরাসের কারণে ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ হলেও এর মধ্যেই ১৭৫টিরও বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরও আড়াই শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। সারাবিশ্বে যেমন নারী নির্যাতন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বাংলাদেশেও। তাই সরকারকে করোনার কথা যেমন বলতে হবে, তেমন নারী নির্যাতনের কথাও বলতে হবে।
ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যদণ্ড, তারপরও ধর্ষণ কেন কমছে না?— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার হয় মাত্র তিন শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশ ঘটনার বিচারই হয় না। ধর্ষণ বিষয়টি প্রমাণ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। যেখানে ভিকটিমকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার ওপর আমাদের বিচার ব্যবস্থা এখনো তেমন নারীবান্ধব নয়। যখন একজন নারী বা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে যান, তখন তাকে নানা ধরনের হয়রানিতে পড়তে হয়। সেইসঙ্গে একটি পরিবারের পক্ষে দীর্ঘদিন মামলা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। আবার কেউ কেউ মামলার মাঝপথে এসে ধর্ষকের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলে। এটাই হলো বাস্তবতা।
শাহীন আনাম আরও বলেন, ‘২০১০ সালে পারিবারিক দমন আইন করা হয়। কিন্তু আমরা সেটা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছি না। অনেকগুলো আইন আছে যেখানে নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবায়ন করায় বিরাট একটা গলদ রয়ে গেছে। আমরা আইন প্রণয়নে তৎপর থাকি, কিন্তু তারপর বাস্তবায়ন করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করি না। তবে নারীরা যে নিজের ঘরে সুরক্ষিত না, এটা আমাদের জন্য লজ্জাকর ও দুঃখজনক। তাই সবার মধ্যে একটা পরিবর্তন আনতে হবে। সেটা হলো— নারীদের সম্মান করা। শুধু আইন দিয়ে বা পুলিশ দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাবে না। ঘরে ঘরে নারীর প্রতি সম্মান এবং তাদের মর্যাদা রক্ষার শিক্ষা আমাদের দিতে হবে।’
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ সদস্য ড. নমিতা হালদার বলেন, ‘করোনাকালে নারী ও শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। বর্তমানে একজন অপরাধপ্রবণ পুরুষ ঘরে থাকতে থাকতে অস্থির সময় পার করছেন। ফলে তিনি নারী নির্যাতন করছেন। করোনার এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। যেভাবে আমরা করোনা ও স্বাস্থ্যবিধিতে নজর দিয়েছি, সেইভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়েও সরকারকে নজর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দফতরকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, স্বামীর নামে নালিশ করলে অনেক নারী গৃহহারা হওয়ার ভয় পান। তাই অনেক নারী সবকিছু বলতে চান না। এরপরও আমি মনে করি, নির্যাতনের শিকার নারীদের এগিয়ে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নিতে হবে। সরকার এবং সংগঠনগুলো নারীদের পাশে থাকলে তারা সুরক্ষিত থাকবে।
লন্ডনের নিউহ্যাম’র কাউন্সিলর আয়েশা চৌধুরী বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর এই নির্যাতন নতুন নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, নারীরা বেরিয়ে আসছে এবং অভিযোগ করার সুযোগ পাচ্ছে। ইংল্যান্ডে বর্তমানে সাড়ে ৩ মিলিয়ন নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই চিত্রটা আগেও ছিল। এখনো নারী ও শিশু নির্যাতিত হচ্ছে। তবে এখানে সামাজিক সুরক্ষাটা বেশ শক্ত।’