‘চীনের চাপে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি, ভারতও পক্ষে ছিল না’
১৬ জুন ২০২০ ০০:৪৮
ঢাকা: মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে নিজ দেশে ফেরানোর বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। সেই চুক্তি করার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল চীনের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে ওই সময় ভারতের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক, যা বাংলাদেশের প্রত্যাশার সঙ্গে মেলেনি। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না ভারত। বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশকে আরও বেশি কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে।
সোমবার (১৫ জুন) সন্ধ্যায় ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে ‘রোহিঙ্গারা যাচ্ছে না কেন?’ বিষয়ক এক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানী। আলোচনায় অতিথি ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।
আলোচনায় সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই করতে হয়েছে। তবে সে চুক্তি করা ভুল ছিল না।
তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফরেন পলিসি কেউ যদি ভুল বলে, সেটা ভুল বলা হবে। এটা বলা যুক্তিযুক্ত না। একসময় যখন আমরা রিসার্চ করব, তখন আমরা অনেক তথ্য দিতে পারব। মিয়ানমারের সঙ্গে আমি কাজ করছি। খারাপ দিকগুলো যা থাকতে হয়, সবগুলো তাদের মধ্যে আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা অনেক ফাইট করেছি। আমি বলব, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ভুল করিনি। এছাড়া আমাদের কাজের স্বাধীনতা ছিল।
https://www.facebook.com/Sarabangla.net/videos/576002139999123/
তিনি আরও বলেন, আমাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়ার পর প্রথমে আমরা কোনো মাল্টিলেটার ফোরামে যেতে চাইনি। কিন্তু পরে যেতে হয়েছে। এমনকি আমরা এটাও জানি, আমাদের চুক্তির কিছুই তারা মানবে না। কিন্তু আমাদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করাটা তখন দরকার ছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বসে থাকেননি। সেটা কিন্তু ইউএনজি’তে (জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন) নিয়ে গিয়েছেন। এখন আইসিসিতে বিচার চলছে। কিন্তু মিয়ানমার তখন মনে করেছে— আমরা ইউএনজি’তে বলব, এরপর ভুলে যাব। কিন্তু সেটা এখন আইসিসিতে বিচারাধীন। মিয়ানমার এটা ভাবেনি যে আমরা আইসিসিতে যাব। বিচার চাইব।
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শহিদুল হক আরও বলেন, মিয়ানমার সবসময় বলে আসছে, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী। তাদের আশপাশের বাসিন্দাদের অবস্থানও মিয়ানমারের পক্ষে। আর ভাসানচর রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো সুযোগ। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসায় পরিবেশের ওপর একটা চাপ আছে। সেটা সবাই মিলে সমাধান করতে হবে। সবশেষে বলব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমারকে সবসময় কঠোর বার্তা দিতে হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, রোহিঙ্গারা যেসব পরিস্থিতির কারণে তাদের স্বদেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছে, সেসব অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এ কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরতে আগ্রহী না। মিয়ানমারও তাদের ফেরানোর উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেনি। বলা যায়, মিয়ানমারের ইচ্ছা নেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার। আইসিসি ও আইসিজিতে এটা নিয়ে কাজ চলছে। আইসিজিতে যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান তাড়াতাড়ি হবে না। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে চীনাদের চাপ ছিল। তারপরও আমি মনে করি, এটা ভুল ছিল। অনেকের বিশ্বাস, চীনাদের চাপে আমরা এটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ চুক্তিতে কিছুই আমাদের হাতে রাখেনি, সবকিছু মিয়ানমারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চট করে এমন একটি চুক্তি সই করার দরকার ছিল না। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন চুক্তি সই করার জন্য তাড়াহুড়া করছিলেন, যা মোটেও ঠিক হয়নি। আমরা ভেবেচিন্তে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে পারতাম। এছাড়া আমাদের সেভ গার্ডগুলো বেশ দুর্বল।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ভাসান চর রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো। তাদের কিছু অংশকে পাঠানো গেলেও ভালো হবে। যারা এখন আছে, তারা এখনকার চেয়ে একটু ভালোভাবে থাকতে পারবে। আর রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে গেলে ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই। একইসঙ্গে সেখানে গেলে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডগুলোও দমন করা যাবে সহজে।
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিবের শেষ কথা, আমি এমন কোনো উদাহরণ দেখতে পাই না যে এরকম সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন থাকবে— এটা ধরে নিতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, চুক্তির ওই সময় আমরা ভারতের ওপর নির্ভর ছিলাম। ওই সময় চীন, ভারত ও রাশিয়ার সহযোগিতা পায়নি বাংলাদেশ। আমাদের যে দুর্বল জায়গাগুলো থেকে গেছে, পলিসিতে সেগুলো আমাদের ঠিক করতে হবে। তা না হলে সামনে আমাদের আরও সমস্যা হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এখনো অনেক কাজ করার আছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনায় আমাদের ঘাটতি আছে। এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
এই অধ্যাপকও মনে করেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ভুল ছিল। এ কারণে সামনের দিনগুলোতে কৌশল নির্ধারণ ও সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ভাসানচর ইস্যুতে অধ্যাপক সাহাব এনাম বলেন, ভাসানচর নিজেদের মধ্যে যতটা রাখা যায়, ততই ভালো। তবে বার্মিজরা মনে করতে পারে, সেখানে যাদের পাঠানো হচ্ছে, তারা ভালো নাকি খারাপ। ভাসানচরে তাদের পাঠানোর বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আমাদেরও বিভিন্ন মত রয়েছে। সেদিকেও আমাদের চিন্তাভাবনা করে সেখানে রোহিঙ্গাদের পাঠাতে হবে।
অধ্যাপক সাহাব এনাম খান এম শহীদুল হক মো. তৌহিদ হোসেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সারাবাংলা ফোকাস