‘স্বল্প জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বিপদাপন্ন অভিবাসী কর্মীরা’
১৬ জুন ২০২০ ১৪:৩০
ঢাকা: বাংলাদেশে যারা রেমিটেন্স পাঠায় সেইসব অভিবাসী কর্মীদের ৯৮ শতাংশই পুরুষ। আর এদের প্রায় ১২ শতাংশ একেবারেই স্কুলে যায়নি এবং প্রায় ৮০ শতাংশ পড়াশোনা করেছেন সেকেন্ডারি স্কুল পর্যন্ত। এছাড়াও রয়েছে তাদের দক্ষতার অভাব। ফলে আয় কম হচ্ছে। এতে প্রবাসে বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছেন তারা। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (১৬ জুন) বাংলাদেশে অভিবাসন, ফ্যামিলি রেমিটেন্স, সম্পদ এবং দক্ষতার শ্রেণীবিভাগ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইওএম। ২০১৯ সালে রেমিটেন্স-নির্ভর এক হাজার পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালনা করে আইওএম। তারপর তারা গবেষণা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে রেমিটেন্স গ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ। রেমিটেন্স গ্রহণকারী পরিবারের মোট ৬৫ শতাংশ পরিচালনা করেন নারী, যারা মূলত বেকার এবং সাধারণত রেমিটেন্সকে অনুৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে খরচ করেন।
জরিপ মতে, রেমিটেন্স মূলত স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হয় এবং সম্পদের বৈচিত্র্য আনতে বা আর্থিক স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে খুব কমই ব্যবহার হয়, যা রেমিটেন্সের ওপর পরিবারের নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের স্বল্প অর্থনৈতিক জ্ঞান তাদেরকে টেকসই উপার্জন, রেমিটেন্স ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক অংশ (৪৯ শতাংশ) কাজ করেছেন কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কর্মচারি হিসেবে এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৬ শতাংশ) কাজ করেছেন শ্রমিক হিসেবে; যার মধ্যে দিন মজুর ও খণ্ডকালীন শ্রমিক রয়েছেন। বাংলাদেশের অভিবাসীকর্মীরা অন্য দেশের দক্ষ কর্মীদের তুলনায় কম অর্থ পাঠাতে পারেন বা অর্থনৈতিকভাবে কম লাভবান হন। কারণ অদক্ষ এবং স্বল্পদক্ষ কর্মীরা যে পরিমাণ অর্থ পারেন তা দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম।
বেশি দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের তুলনায় অধিক অর্থ দেশে পাঠায়। দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে মাসিক হারে প্রায় ২৫৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত। অভিবাসীদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে রেমিট্যান্স কীভাবে বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় করা হবে। দক্ষ অভিবাসীরা পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ করে সঞ্চয় অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স বিনিয়োগ করতে। আর অদক্ষ অভিবাসীরা তাদের রেমিট্যান্স মূলত লোন পরিশোধে খরচ করে। অন্যদিকে বেশি দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসী কর্মীরা ভালো বেতনের চাকরিতে নিয়োগ পান এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্পদক্ষ কর্মীদের তুলনায় বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়ে থাকেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই সাত লাখ অভিবাসী কর্মী দেশ ছেড়ে বিদেশে যান কর্মসংস্থানের খোঁজে। ২০১৯ সালে প্রবাসীরা বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠায়, যা দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে পাঠানো রেমিটেন্সের ৭৩ শতাংশের বেশি রেমিটেন্স আসে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের দেশগুলো থেকে। বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহ সরাসরি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে এবং অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে।
কোভিড-১৯ মহামারি সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটের ফলে হাজার হাজার অভিবাসী কর্মী বছর শেষে দেশে ফিরে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মন্দা সংক্রান্ত কারণে চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের ফলে শুধুমাত্র রেমিটেন্স গ্রহণকারী পরিবারগুলোই নয়, প্রভাবিত হবে তাদের কমিউনিটিও।
গবেষণায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়, এর মধ্যে রয়েছে জেন্ডার-সংবেদনশীল দক্ষতা বিকাশের জন্য বিনিয়োগ করা, পরিবারের অর্থনৈতিক জ্ঞান ও রেমিটেন্স পরিচালনার ক্ষমতা তৈরি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে যাতে করে স্বল্পদক্ষ অভিবাসী কর্মী আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং ঋণের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে। তৃতীয়ত, বিপদাপন্নতা হ্রাসে এবং আর্থিক স্বাধীনতার পথে সহায়তা প্রদানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন উন্নত ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং সঞ্চয়ের আনুষ্ঠানিককরণ নিশ্চিত হয়। চতুর্থত, নারীদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক নীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে করে অর্থনীতির পরিমাপ এবং টেকসই কৌশলসমূহ বিবেচনা করে সম্পদ উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সর্বশেষে, অভিবাসী ও রেমিটেন্স প্রাপকদের জেন্ডার-সংবেদনশীল অর্থনৈতিক শিক্ষা এবং পরামর্শ দেওয়ার জন্য পার্টনারশিপ গঠন করা।
গবেষণা ফলাফল বিষয়ে আইওএম বাংলাদেশ মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, ‘অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় এখন আমাদের মন্দা-প্রভাবিত রেমিটেন্স নির্ভর মানুষকে সহায়তায় অধিক নজর দিতে হবে। অভিবাসী কর্মীদর দক্ষতা বিকাশকে অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য সরকারকে সহায়তা করা প্রয়োজন, যাতে তারা বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে পারে। সেইসঙ্গে তাদের পরিবার, বিশেষ করে নারীদের অর্থনৈতিক শিক্ষা প্রদানে গুরুত্ব দিতে হবে; যাতে করে রেমিটেন্সের উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত হয় এবং রেমিটেন্স নির্ভর পরিবারগুলোর স্থিতিস্থাপকতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তৈরি হয়।
আন্তর্জাতিক ফ্যামিলি রেমিটেন্স দিবসে উপলক্ষে সব জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীদের ফের একত্র করতে সহায়তা প্রদান এবং অপবাদ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএম।