এরশাদের প্রয়াণের ১১ মাস: ‘নাই’ হয়ে গেছে জাপা’র রাজনীতি
১৮ জুন ২০২০ ১৪:২১
ঢাকা: প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রয়াণের পর থেকেই সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতির অবস্থা বেহাল। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, একদিকে নেতৃত্বের কোন্দল, অন্যদিকে ‘যোগ্য নেতৃত্বে’র অভাব— দুইয়ে মিলে নামকাওয়াস্তে টিকে রয়েছে দলটি। সাংগঠনিক কর্মসূচির অভাবে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারে ‘নাই’ হয়ে গেছে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্তমানে দলের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রভাব কেটে গেলেও তাদের অনেককেই আর দলের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যাবে না। বড় একটি অংশ দলছুটও হতে পারেন। নেতৃত্বের সংকটকেই বড় অভাব হিসেবে ধরা দিচ্ছে তাদের কাছে। তারা মনে করছেন, বর্তমান নেতৃত্বের হাত ধরে এই দলের নিজস্ব শক্তিতে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
গত বছরের ১৪ জুলাই মারা যান জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার প্রয়াণের পর থেকেই দলের সাংগঠনিক ভঙ্গুর দশার চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। এরশাদের ‘চল্লিশা’র আয়োজনের অব্যবস্থাপনা থেকে এর শুরু। কিছুদিন পরই দলের নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয় সংকট। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ আর ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে দলের মধ্যে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা আর জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান পদ মেনে নিতে সম্মত হলে ভাঙন ঠেকে। তবে সাংগঠনিকভাবে দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
দলের সিনিয়র-জুনিয়র একাধিক নেতা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, দলের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই এখন নিষ্ক্রিয়। তার ওপর দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে নেতাকর্মীদের কোনো যোগাযোগ নেই। এরশাদ জীবিত থাকাকালে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। কিন্তু পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ কারও নেই। নেতাকর্মীদের নিয়ে চেয়ারম্যান চিন্তাভাবনা করেন না বলেও অভিযোগ অনেকের।
নেতাকর্মীরা বলছেন, দলের ২২ জন নির্বাচিত ও চার জন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যের কেউ সাংগঠনিক দায়িত্ব নিতে চান না। তাদের সঙ্গেও নেতাকর্মীদের দূরত্ব রয়েছে। তারা বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ব্যস্ত। অভিযোগ আছে, আসন ভাগাভাগি আর মনোনয়নের চক্করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে পার্টির চেয়ারম্যান-মহাসচিবও যোগাযোগ রাখেন না। তারা দল বা দেশ নিয়েও ভাবেন না। ফলে দেশব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি চললেও জাতীয় পার্টি কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেন না।
এদিকে, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ছিল, তা পুরোপুরি কাটেনি বলেও মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, দলের শীর্ষ এই দুই নেতা দলের মধ্যে নিজ নিজ বলয়ের মধ্যেই থাকেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও। তিনিও নিজের মতো করে একটি বলয় নিয়ে চলেন। এতে করে সাধারণ নেতাকর্মীরা দলের মধ্যে দল খুঁজে পান না। তাতে করে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।
শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বিতীয় স্তরসহ তৃণমূলের যোগাযোগহীনতায় যখন সাংগঠনিক শূন্যতা বিরাজ করছে, একই সময়ে পার্টির অর্থনৈতিক সামর্থ্যও তলানিতে ঠেকেছে বলে জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন প্রথম সারির নেতা বলেন, দলের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। এরশাদ যখন ছিলেন, তিনি যেভাবেই হোক, যেকোনো কর্মসূচি বা আয়োজনকে সামনে রেখে অর্থ জোগাড় করে ফেলতেন। কিন্তু এখন দলের ফান্ড বলতে কিছু নেই। দলের প্রয়োজনেও খুব একটা হাত খোলেন না কেউ। ফলে দলের কর্মসূচিহীন হয়ে পড়ার পেছনে আর্থিক সক্ষমতার অভাবটাও ভূমিকা রাখে। পার্টির চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলেই কিছু করতে পারেন না টাকার অভাবে।
বর্তমান পরিস্থিতির মতো জাতীয় পার্টি ‘ধুঁকে ধুঁকে’ কতদিন চলবে, তা নিয়েই শঙ্কা অনেকের। তারা বলছেন, দলের শীর্ষ ১০/১২ জন নেতা বিএনপির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আর শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলছে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রাকোপ কমার পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন শুরু হবে, তখন অনেক নেতাই দলছুট হয়ে যেতে পারেন। তাদের সঙ্গে ছুটবেন অনুসারীরাও। এ পরিস্থিতি ঠেকাতে যে সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন, তা রওশন এরশাদ, জি এম কাদের বা মশিউর রহমান রাঙ্গার নেই বলেই মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা সারাবাংলাকে বলেন, জাপা’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদ বেঁচে থাকতেই দলের ভাঙন প্রকাশ্য হয়েছিল। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে কাকে অগ্রাধিকার দেবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। আর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দল তো প্রায় দুই ভাগই হয়ে গিয়েছিল। এরশাদ সুতো হয়ে জোড়া লাগিয়ে রেখেছিলেন। এখন তার অবর্তমানে এই দল হয়তো এভাবেই আধা সক্রিয় হয়ে চলবে।
জানতে চাইলে দলের নানা ধরনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেন নেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আজ নেই নেই। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অভাব অনুভূত হচ্ছে। তিনি যেভাবে দলকে আগলে রাখতেন, তেমনভাবে দলকে আগলে রাখার কেউ নেই। ফলে দলের নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছি আমরা সবাই।
বাবলা আরও বলেন, দল চালানোর জন্য শীর্ষ নেতাকে তো নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, প্রয়োজনে নরম হতে হয়। এরশাদ বেঁচে থাকতে পরিস্থিতি বুঝে সেভাবে কাজ আদায় করে নিতেন। তার মতো করে আসলে দলের জন্য সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারছে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে। তিনি অবশ্য এসব অভিযোগ-সংকটকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি সাারবাংলাকে বলেন, এখন তো করোনাভাইরাসের কারণে সব দলের অবস্থাই খারাপ। সব দলই তো সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রমও করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে। এটি বড় সমস্যা নয়। করোনা কেটে গেলে আমরা আবার আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করব।