করোনাকালে শরণার্থী জীবন
২০ জুন ২০২০ ১৫:২২
আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এই দিনকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত ১৮ই জুন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ পৃথিবীতে সাত কোটি পঁচানব্বই লাখের বেশি মানুষ কোন না কোন কারণে জোরপূর্বক উদ্বাস্তু হয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় এক কোটি বেড়েছে অর্থাৎ দ্বিগুণ হয়েছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা। বাস্তুচ্যুত মানুষদের এই সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই পর্যন্ত সর্বোচ্চ! কেবল বাস্তুচ্যুতই নয়, প্রায় দুই কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ মানুষের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী অন্য দেশে শরণার্থী হয়েছে। চার কোটি সাতান্ন লক্ষ মানুষ তাদের নিজের দেশেই বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছে। বিয়াল্লিশ লাখ মানুষ আশ্রয়প্রার্থী বিভিন্ন দেশে। প্রায় তিন কোটি শরণার্থী জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশী আঠারো বছরের নিচে। এই শিশু কিশোরদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পরিবারবিহীন, বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া এই সব শরণার্থী পরিবারের ৭০ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। নিজের দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষদের মধ্যে পঁচিশ শতাংশ তরুণী আর চার শতাংশ গর্ভবতী নারী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। এই পর্যন্ত একমাত্র দক্ষিণ সুদান থেকেই বিশ লাখের বেশি মানুষ অন্যদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মাত্র দশ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে একটি সিরিয়ান শরণার্থী বালিকার মাসিকজনিত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা যায়। মাত্র পঁয়ত্রিশ মার্কিন ডলারের (দুই হাজার নয়শ টাকা) বিনিময়ে একটি রোহিঙ্গা পরিবারের (প্রতি পরিবারে ছয়জন মানুষ) দুই সপ্তাহের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।
শরণার্থী নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘এইচআইএএস’ এক জরিপের ভিত্তিতে জানিয়েছে, করোনা মহামারির আগে ১৫ শতাংশ বাস্তচ্যুত মানুষের খাদ্য সংকট ছিল। কিন্তু এখন তা বেড়ে ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছে ৭৫ শতাংশ। সূত্র : আলজাজিরা।
এক বছরের মধ্যে এক কোটির বেশি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ মূলত দুইটা বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। প্রথম কারণ, দেশে দেশে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশ কঙ্গো, সাব সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধ, ইয়েমেন আর সিরিয়ার যুদ্ধ তাড়িত মানুষ এই কোটি মানুষের একটা বড় সংখ্যা। উল্লেখ্য, সিরিয়ার যুদ্ধ দশ বছর ধরে চলছে। প্রায় এক কোটি বত্রিশ লাখ সিরিয়ান হয় শরণার্থী অন্য দেশে, অথবা নিজের দেশের মধ্যেই উদ্বাস্তু। সিরিয়ান উদ্বাস্তু মানুষেরাই মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের ছয় ভাগের এক ভাগ। দ্বিতীয় কারণ, প্রথমবারের মতো ভেনিজুয়েলার উদ্বাস্তু মানুষ, যারা বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হয়েছে।
রিপোর্টটিতে আরও জানা যায়, পৃথিবীর পাঁচটি দেশের মানুষ মোট শরণার্থীর দুই তৃতীয়াংশের সমান- দেশগুলো হলো সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান এবং মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া এগারো লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে।
রিপোর্টটিতে উল্লেখ করেছে, নব্বইয়ের দশকে বছরে গড়ে পনেরো লাখ শরণার্থী নিজের দেশে ফেরত গিয়েছেন কিন্তু গত এক দশকে সেই সংখ্যা তিন লাখ পঁচাশি হাজারে নেমে এসেছে। এর অর্থ শরণার্থী সমস্যা একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা এখন।
এই ফ্যাক্টস এন্ড ফিগারগুলোর সাথে যাদের নিয়মিত যোগাযোগ তারাই জানেন, প্রতিটি সংখ্যার পিছনে আছে মানুষদের চেহারা। সেই চেহারাটা আমার মতো, আপনার মতো। কালো, ফর্সা, বাদামী রঙের সেই সব মানুষেরা তাঁরা হয়, আরবি ভাষী, সোয়াহিলি, বার্মিজ অথবা স্প্যানিশ ভাষী। প্রতিটি সংখ্যার একটি মানবিক গল্প আছে। নিজের ঘর থেকে, নিজের দেশ থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার গল্প। নিজের পরিচয় হারিয়ে ‘শরণার্থী’ ছাপ লেগে যাওয়ার বেদনা, রাগ আর ক্ষোভের গল্প। স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প। রাতের মধ্যে সচ্ছল বা কোটিপতি থেকে অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকার গল্প।
করোনা মহামারীর এই দুর্যোগে এই সব শরণার্থীদের জীবন আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা সময়ে শরণার্থীদের খাদ্য সমস্যা প্রবল হবে। তুরস্ক, উগান্ডা, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, বসনিয়া, লেবাননের শিবিরের কথা টিভিতে দেখি। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে নিজের চোখে দেখি, কি অবস্থায় আছেন নারী ও শিশুরা। শিবিরে কর্মরত মানবিক সহায়তা কর্মীদের কথাও বলতে হয়, এই মহামারীকালেও যারা নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে শরণার্থীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এই করোনা মহামারীর সময়েও তিরিশ হাজারের বেশী মানবিক সহায়তা কর্মী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছেন। আর সারা পৃথিবীব্যাপী কয়েক লক্ষ মানবিক সহায়তা কর্মী কাজ করছেন।
আমার সংস্থা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে দীর্ঘমেয়াদী ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম করে আসছে ২০১৭ সাল থেকে। ১১টি শিবিরে কাজ করি আমরা। যদিও সবাই জানেন তাও আবার বলি, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরটা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শিবির। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় চল্লিশ হাজার শরণার্থী পরিবারের বসবাস।
করোনা মহামারীর শুরুতেই মানবিক সহায়তা কর্মীরা করোনা প্রতিরোধের সকল তথ্য বার্মিজ ভাষায় শিবিরগুলোর প্রতিটা ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের সংস্থা তিন হাজারের মতো হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে, সাবান এবং জলের ব্যবস্থাসহ। মসজিদের মাইকে ইমামদের দিয়ে প্রতিরোধের তথ্য জানানো হচ্ছে নিয়মিত। মাস্কের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হলেও রোহিঙ্গারা তেমন আমলে নিচ্ছেন না বলেই ধারনা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার এই ঘনবসতিতে। তবুও মানবিক সহায়তা কর্মীদের চেষ্টার ত্রুটি নাই। চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই জীবন, সে নিজের জন্য হোক কি অপরের জন্য।
জরুরী কার্যক্রমের আওতায় নিয়মিত খাদ্য এবং গ্যাসের সরবরাহ, চিকিৎসা সেবাদান চলছে আগের মতোই। তবে আগে মাসে দুই দফায় খাদ্য সরবরাহ করা হতো, এখন একবারেই পুরো মাসের খাদ্য সামগ্রী দিয়ে দেয়া হচ্ছে যাতে রোহিঙ্গা এবং কর্মী উভয়েই কম এক্সপোজড হয়। এছাড়া সাইট ম্যানেজমেন্ট আর পানি এবং পয়নিস্কাশন কাজও চলছে। যদিও কর্মীসংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছে। কর্মীদের রোটেশনে কাজ করতে হচ্ছে। একদল চৌদ্দ দিন একটানা কাজ করে কোয়ারিন্টিনে চলে যাচ্ছে, দ্বিতীয় দল আবার চৌদ্দ দিন কাজ করছে।
করোনাকালে কেবলমাত্র বিশেষ জরুরী কার্যক্রমের কর্মীরা ছাড়া অন্যদের উপরে ক্যাম্পে যাতায়াত করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে তবও আমি কিছুদিন আগে উখিয়াতে সদ্য তৈরি আইসোলেশন সেন্টারটি দেখতে গিয়েছিলাম। ইউএনএইচসিআর এর আর্থিক সহায়তায় ব্র্যাকের ইঞ্জিনিয়ারিং আর শেল্টার বিভাগের কর্মীরা মাত্র পাঁচ সপ্তাহে এই একশ পঞ্চাশ বেডের সেন্টারটি বানিয়েছে। অক্সিজেন সুবিধাসহ এই আইসোলেশন সেন্টারটি শিবিরের করোনা আক্রান্তদের জরুরী চিকিৎসা সেবার জন্য।
এখন যেহেতু জনসমাগম বন্ধ তাই রোহিঙ্গা নারীরা আগের মতো নারী বান্ধব সেন্টারগুলোতে আসতে পারছেন না। কিশোরীরাও ঘরে থাকছে। শিশুদের চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসগুলোও বন্ধ। বেশ কয়েকটি স্কুলকে আপাতকালীন কোয়ারিন্টিন সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে। আমাদের সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সিলররা চেষ্টা করে যাচ্ছে যতখানি সম্ভব সেবা দিতে। দেখা যাচ্ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বেড়ে যাচ্ছে এই ঘরবন্দিকালে। শিশুদের শারীরিক শাস্তি বেড়ে গেছে। নারীরা, মেয়েরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই বিষণ্ণতা দূর করার সহায়তা চাইছেন, জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাচ্ছে শারীরিক নির্যাতনের কাহিনী। করোনাপূর্ব জীবন তো এখন ইতিহাস, কিন্তু পোস্ট করোনাকালে এই পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি না নিলে এদের একটা বড় অংশ আর মানসিক সুস্থতা ফিরে পাবে কিনা কে জানে? আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা।
একজনের সাথে কথা হলো, কথা আর কি, আমি জানতে চাই এটা সেটা, সে হুঁ হা করে। ধরি তার নাম জুলেখা, বছর তেইশ-চব্বিশ হবে, না সে কোন বাদশার মেয়ে নয়, বছর দুয়েক আগে হয়তো তার ঘর ছিল, স্বামী ছিল, কোলে একটি শিশু ছিল। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি এক বৃষ্টির রাতে তাদের গ্রাম ঘেরাও হলো, পুরুষদের কচুকাটা করা হলো, আগুন জ্বেলে সেখানে শিশুদের ছুঁড়ে ফেলা হলো। স্বামী আর ভাশুরের শরীরের ফিনকি দেয়া রক্তের গন্ধ আজো তার নাকে লেগে আছে। দুই বছরের কোলের ছেলেকে শূন্যে ঘুরিয়ে আগুনে ছুঁড়ে ফেলার পরে খুব সম্ভবত শিশু করোটি কিছুর সাথে আঘাতে শব্দ করে ফেটে গিয়েছিল। পালাক্রমে ধর্ষণের পরেও জুলেখা বেঁচে আছে। শিবিরে আসার এক বছর পরে জুলেখার বিয়ে হলো। জুলেখা এখন গর্ভবতী। চেহারার হিজাব সরানোর পরে তার কালো হয়ে ফুলে উঠা চোখের দিয়ে তাকিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। সে এসেছে আমাদের কাউন্সেলিং নিতে।
কয়েক হাজার কিশোরী এই করোনাকালে প্রথমবারের মতো ঋতুমতী হবে, তাদেরকে কিভাবে মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা দেয়া যাবে! কতজন অজ্ঞানতার কারণে অসুখবিসুখে ভুগবে, সেই হিসাবটাও পাওয়া যাবে পরে।
আমাদের সাহসী সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সিলর বীর মেয়েরা, নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও রোহিঙ্গা নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার সেবা দিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রয়োজনীয় পিপিই পরেই কাজ করছে। ভয় লাগে কিনা এই প্রশ্নে জানায়, ভয় লাগে কিন্তু আমাদের তো প্রটেকশন আছে, আর আমি যদি সাহায্য না করি তবে রোহিঙ্গা নারীদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
আমার মনে পড়ে যায় ইবোলা মহামারীর সময়ে উগান্ডার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্র্যাকের এক স্বাস্থ্যসেবিকার কথা। সে বলেছিল, ইবোলার জন্য অনেক ভয় লাগে, কিন্তু আমি যদি মানুষকে দরকারের সময় সেবা দিতে না পারি তাহলে আমার এই জ্ঞান আর শিক্ষা কি কাজে লাগবে! মানবিক সহায়তা কর্মীদের একটাই ধর্ম- মানবিকতাকে সবার উপরে তুলে ধরা, তা সে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেই হোক, কি মহামারীর কালেই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী, কক্সবাজার