ঢাকা ছাড়ছে কর্মহীন মানুষ, বাসায় বাসায় টু-লেট
২২ জুন ২০২০ ০৬:৫৬
ঢাকা: রাজধানীর ওয়ারীতে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন বিপ্লব রহমান। কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এপ্রিলে তার চাকরি চলে গেছে। ভেবেছিলেন লকডাউন উঠে গেলে নতুন কোনো কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। বাধ্য হয়ে শেষ পুঁজিটুকু দিয়ে দুই মাসের ঘরভাড়া মিটিয়ে ভোলার বোরহান উদ্দীনে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন এ মাসেই।
টিকাটুলির এক প্রকাশনা ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) লোন করে দেড় বছর আগে ৬৫ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। গত দুমাস ব্যবসা বন্ধ থাকায় জমানো টাকা থেকে কর্মচারীদের বেতন দিয়ে বিদায় করেছেন। কিন্তু দুই মাসে পাহাড় সমান দাঁড়িয়েছে ফ্ল্যাটের কিস্তি। এখন সেই ফ্ল্যাট বিক্রির কথা ভাবছেন তিনি।
এরকম অবস্থা চলছে পুরো রাজধানীর জুড়ে। করোনায় লকডাউন থাকায় অর্থনৈতিক মন্দা চেপে বসেছে বাংলাদেশেসহ পুরোবিশ্বে। এ সময় কারও চাকরি চলে গেছে। কারও বেতন কমে গেছে। আবার কারও কারও কর্মক্ষেত্রই বন্ধ হয়ে গেছে। একদিকে আয়ের পথ বন্ধ, অন্যদিকে বেতন সংকুচিত হওয়ায় অনেকের পক্ষেই ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আয়ের পথ বন্ধ হওয়া এমন অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছেন। আবার অনেকে যাওয়ার চিন্তা করছেন। আর সে কারণে ঢাকার বাড়িওয়ালারাও পড়েছেন লোকসানে। অনেকে দিনের পর দিন টু-লেট লাগিয়েও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না। কেউ কেউ ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার পরও ভাড়াটিয়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর যারা ঢাকায় রয়ে গেছেন তারাও অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় যেখানে বাড়ি পাওয়া যায় সেখানে চলে যাচ্ছেন। ফলে ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে থাকছে।
দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অফিস মতিঝিল। তিনি থাকেন আরকে মিশন রোড এলাকায়। করোনার প্রভাবে বেতন কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। আর তা আগামী মাস থেকেই কার্যকর হতে যাচ্ছে। তাই আগে ভাগেই ২৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসা ছেড়ে মুগধায় ১৪ হাজার টাকার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। তার আগের বাসার উপরের ফ্ল্যাট মালিক তিন হাজার টাকা ভাড়া কমিয়েও ভাড়াটিয়া ধরে রাখতে পারেননি।
রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকা থেকেই কম-বেশি এমন পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টানা ৬৬ দিন সবধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এমন কঠোর নির্দেশনায় এই দীর্ঘ সময়ে অচল হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতির চাকা, যা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দিনমজুর থেকে শুরু করে স্বচ্ছল চাকরিজীবীদের মাঝেও এর প্রভাব পড়েছে।
এমনিতেই নানা কারণে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের প্রায় সবসময়ই ঝামেলা থাকতে দেখা গেছে। এবার করোনাভাইরাস দু-পক্ষকেই বিপদে ফেলেছে। করোনায় ঢাকার বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই লোকসানে পড়েছেন। মোহাম্মদপুরে মোহাম্মাদীয়া হাউজিং লিমিটেডের সাত নম্বর রোডের বাড়িওয়ালা আশিকুর রহমান জানান, তার চারতলা বাড়ির দুই পরিবার মে মাসে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। দুমাস হতে চললো ভাড়াটিয়ার দেখা নেই। স্বাভাবিক সময়ে কখনও বাড়ি এভাবে খালি থাকে না বলে জানান তিনি।
এদিকে গত ৯ জুন ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি সংগঠন এপ্রিল, মে ও জুন মাসের ভাড়া মওকুফের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। সংগঠনের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই কর্মজীবীরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন। এখন তো অনেকেই বেকার। এদের অধিকাংশ গ্রামে চলে গেছে। আর যারা আছে তাদের ঘরভাড়া দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। তাই আমরা বলছি, লকডাউন ও বিধি-নিষেধ চলাকালীন তিন মাসের ঘর ভাড়া যদি মাফ করে দেয়।’
দেশের চাকরির বাজারে করোনা কতটা ক্ষতি করেছে তার হিসাব যদিও সরকারের কাছে নেই। কিন্তু বেসরকারিভাবে জরিপ করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলছে, ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি আর লকডাউনে প্রায় ৫ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলছে, এই সময়ে ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এখন এই কমে যাওয়া আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে টিকে থাকা নিঃসন্দেহে কঠিন হয়ে পড়বে।
কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়াটিয়া পরিষদ রাজধানী ঢাকা লকডাউন