‘অর্থনৈতিক মন্দা থেকে দেশকে রক্ষা করাই আ.লীগের বড় চ্যালেঞ্জ’
২৩ জুন ২০২০ ০১:১১
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বরিশালের আছমত আলী খান (একে স্কুল) ইনস্টিটিউটে পড়া অবস্থায় ১৯৬৯ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধও তার জীবনের গর্বিত অধ্যায়। ছিলেন বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ধীরে ধীরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। পরে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এক সময় সংগঠনটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হলেও দলে তার অসামান্য অবদানের কারণে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি দেন। দলের ২১তম কাউন্সিলে ১৯ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর তালিকায় স্থান পান তিনি। সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী কন্যা শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের অগ্রভাগে থাকা এই রাজনীতিক হলেন অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১ বছর পূর্তি উপলক্ষে দলটির পথচলা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আন্দোলন ও সংগ্রামের বিভিন্ন দিক নিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডয়াম সদস্য সম্প্রতি কথা বলেছেন সারাবাংলার সঙ্গে। আর এই কথোপকথনে সারাবাংলার পক্ষে অংশ নেন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট নৃপেন রায়। দুজনের কথোপকথনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হলো-
সারাবাংলা: বাংলাদেশের ঐহিত্যবাহী ও প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে, একজন নেতা হিসেবে দলটির এই ৭১ বছরের পথচলায় গুরত্বপূর্ণ অর্জন কোনটি বলে মনে করেন?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭১ বছর পেরিয়ে ৭২ বছরের পা ফেলতে যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের এই ৭১ বছরে বিশাল অর্জন রয়েছে। বাঙালি ছিল পরাধীন জাতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর দলটির প্রথম দায়িত্ব ছিল জাতিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করা। একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্ব পালন করেছে। দলটি পাকিস্তান শাসনামল থেকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, সত্তরের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে কিন্তু স্বাধীনতার পথে নিয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সারাবাংলা: আপনার দৃষ্টিতে ৭১ বছরে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় কোন কোন ট্র্যাজেডি এসেছে? সেই ট্র্যাজেডি কীভাবে মোকাবিলা করেছেন?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭১ বছরে অনেক কিছু হারিয়েছে। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এটা বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের চার জাতীয় নেতাকে কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে। তবুও আওয়ামী লীগ টিকে ছিল। বাংলাদেশকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ও মোশতাকরা। খুনি মোশতাকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা এই বাংলাদেশকে একটি পাকিস্তানের তাবেদার রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের লাখো-কোটি নেতাকর্মী সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে। ওই কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের একেকজন নেতাকর্মী একেকজন ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা সবসময় ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন। সেজন্যই সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোটের দুঃশাসনের সময় ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ইতিহাসের নির্মম নৃশংস বর্বরতম গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আমাদের প্রাণপ্রিয় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতির ইতিহাসে একটি জঘন্য, নির্মম, সহিংস ও বর্বরতম ঘটনা। সেই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। সেদিন গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আহত হন আমাদের অনেক নেতাকর্মী। শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার।
সারাবাংলা: ৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াটা কীভাবে হয়েছিল?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: ৭৫-এর দীর্ঘদিন পর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফেরেন। তখন কিন্তু জিয়াউর রহমানের স্বৈরশাসন চলছে। চলছে হত্যার পালাবদলের রাজনীতি। এক জেনারেল থেকে আরেক জেনারেলের কাছে ক্ষমতার পরিবর্তন। সংবিধান কাটাছেঁড়া। বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার ধমনীতে, সেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরেই এ সবকিছুর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। হত্যা, হামলা, মামলার মধ্য দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করতে করতে এক সময় তিনি বাঙালির ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
সারাবাংলা: ৯০ পরবর্তী সময়ে আপনার যখন ক্ষমতায় এলেন তখন আসলে দেশের অবস্থা কেমন ছিল? সেখান থেকে আজকের বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন।
জাহাঙ্গীর কবির নানক: স্বৈরাচার সরকারগুলো ১৫ বছরে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে ফেলেছিল। যে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু রেখে গিয়েছিল সেই বাংলাদেশ গণলুটপাটের শিকার হয়েছিল। অনেকের মাঝে এমন ধারণা পোক্ত হয়েছিল যে, এই বাংলাদেশ আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সেই বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের নেতা শেখ হাসিনা। তিনি শুধু স্বপ্নই দেখাননি, তা বাস্তবায়নও করেছেন। যে কারণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আজকের সরকার। পর পর তৃতীয়বার যে সরকার নেতৃত্ব দিচ্ছে বৃহৎ এই দলটি। এটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার। এই সরকার আসলেই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে, পরিবর্তন এনেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করেছে। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল।
সারাবাংলা: আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ৭১ বছরের পথচলায় আগামী দিনের নেতৃত্বকে কোন চ্যালেঞ্জটা গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করতে হতে পারে?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বাংলাদেশ ও বিশ্ব। সারাবিশ্ব কিন্তু আগামীতে একটি বিরাট অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে এই বাংলাদেশকে রক্ষা করা ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হলো আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই কোভিড-১৯ আক্রান্ত বাংলাদেশের জীবন এবং জীবিকা দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে আমরা আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতি ধরে রাখব। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আমরা সেই চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটাবোই ইনশাল্লাহ।
সারাবাংলা: দীর্ঘ ৭১ বছরের পথচলায় টানা মেয়াদে সরকারে থাকায় ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগে হাইব্রিড নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ নিয়ে তৃণমূলের ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী দিনে আপনাদের পদক্ষেপ ও করণীয় কী?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: আওয়ামী লীগ টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকার কারণে কিছু অনুপ্রবেশকারী যে ঢোকেনি সেটি আমি অস্বীকার করার উপায় নেই। এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করার জন্য আমরা প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছি। এদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি আমরা। ইতোমধ্যে অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আগামীতে তাদের দল থেকে বিতাড়িত করব।
সারাবাংলা: ১৯৮১ সাল দলীয় সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও নেতৃত্ব নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই। এছাড়া বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আপনারা কতটুকু সফল?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল একজন রাষ্ট্রনায়ক। তার নেতৃত্বেই আজকের বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। দেশের পাশাপাশি তিনিও একজন রোল মডেল। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি তিনি যেভাবে মোকাবিলা করছেন, জীবন ও জীবিকা দুটোকেই যেভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন- এটি করা না গেলে দেশ আবারও দুমড়ে-মুচড়ে পড়বে। আবার পিছনে চলে যাবে। সে কারণেই জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘জীবন ও জীবিকা’ দুটোই পাশাপাশি এগিয়ে নেওয়ার থিওরি সবাই গ্রহণ করেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই সেটি পরিচালনা করছেন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের তাদের সঙ্গে কথা বলছেন; করোনাসহ অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে কথা বলছেন; জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলছেন, দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। কাজেই তার দিক-নির্দেশনায় করোনাভাইরাসকে পরাজিত করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। একদিন জীবন ও পৃথিবী হাসবেই।
সারাবাংলা: সবশেষে দেশের জনগণ, নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে কী বলতে চান?
জাহাঙ্গীর কবির নানক: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আগামীতে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। আর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের জনগণ, নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থকসহ সবাইকে আমার পক্ষ থেকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা।
সারাবাংলা: আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সারাবাংলার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। আর আমাদের এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জাহাঙ্গীর কবির নানক: বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে সারাবাংলাও এগিয়ে যাক। আপনাদের সংবাদ ছড়িয়ে যাক সারা বাংলায়। আপনাকেও ধন্যবাদ।
অর্থনৈতিক মন্দা আওয়ামী লীগ সভাপতি আওয়ামী লীগের ৭১ বছর পূর্তি চ্যালেঞ্জ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাহাঙ্গীর কবির নানক শেখ হাসিনা