নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় উত্তপ্ত জাতীয় সংসদ, বিএনপির ওয়াকআউট
২৩ জুন ২০২০ ১৮:১৫
ঢাকা: জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ তার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন তারেক রহমানকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। একইসঙ্গে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। তার এমন বক্তব্যে সংসদে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা এ সময় ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা হৈ চৈ করতে থাকেন। এসময় অধিবেশনের সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া এমপি হারুনের ‘অসংসদীয়’ শব্দগুলো সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ ঘোষণা করলে প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে চলে যান বিএনপির ওই সংসদ সদস্য।
এক সপ্তাহ মুলতবির পর আজ মঙ্গলবার (২৩ জুন) সকাল ১১টায় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পসংখ্যক সংসদ সদস্য অধিবেশনে যোগ দেন। অধিবেশনের শুরুতেই দেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্যরা। এরপর প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। তারই এক পর্যায়ে বিএনপির এমপি হারুনুর রশিদ ওয়াকআউট করেন।
ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে বাজেট আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, সরকারি দলের আমিরুল হক মিলন, উম্মে কুলসুম স্মৃতি, মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম, বিএনপির হারুনুর রশীদ এবং বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা ও জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রস্তাবিত বাজেটকে গণমুখী ও উন্নয়নমুখী আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ১২টি বাজেট আমরা বাস্তবায়ন করেছি। সব লক্ষ্য আমরা অর্জন করেছি। প্রতিটি বাজেটের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি। করোনার কারণে গত তিন মাস দেশের অর্থনৈতিক চাকা প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সারাবিশ্বের মানুষ করোনা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। করোনা চিরস্থায়ী হতে পারে না, এটা একদিন স্থবির হবেই। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা আমরা অবশ্যই অর্জন করবো।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, অনেক দেশ বাজেট তৈরি করতে পারেনি। কিন্ত সংকটের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বাজেট দিয়ে জাতিকে গৌরবাম্বিত করেছেন। একটি অস্বাভাবিক অবস্থা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক। বরাদ্দ না বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কমানো হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় কারিগরি নয়, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ টিম দ্রুত তৈরি করতে হবে, সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে রাজস্ব অফিস এবং ৫০ লাখের বেশি হাট-বাজারকে রাজস্বের আওতায় আনলে বাজেটের টার্গেট পূরণ হবে। আমরা ধারে ঋণ নিয়ে ঘি খেতে চাই না। যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম করেছে, তাদের টাকা ফেরত আনতে হবে। করোনা পুষে রেখে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে না, দুর্নীতি পুষে রেখে উন্নতি হবে না।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকারের প্রাণান্ত প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে বলেন, করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। টেস্টিং ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। করোনার আঘাত অর্থনীতিসহ সব খাতেই লেগেছে এবং লাগবে।
ইন্টারনেট ও মোবাইলের ওপর আরোপিত চার্জ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় যেতে হবে। আর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অনৈতিক বলেই আমি মনে করি। কথায় কথায় কোরআানের কথা বলা আর এতিমের টাকা আত্মসাতৎকারী দণ্ডিত আসামীর পক্ষে সাফাই গাওয়া— দু’টো একসঙ্গে চলতে পারে না।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। করোনায় পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যেও অর্থমমন্ত্রী একটি সাহসী বাজেট দিয়েছেন। প্রতি বাজেটের সময়ই বিএনপি ও কিছু প্রতিষ্ঠান পাণ্ডিত্য ফলাতে বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতি বাজেট বাস্তবায়নের হার ৯৫-৯৬ ভাগ। উচ্চাভিলাষ না থাকলে অভিলাষ পূরণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা থাকে না। সরকারের উচ্চাভিলাষ ছিল বলেই প্রতিটি বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সীমিত সম্পদ নিয়ে দিনরাত প্রধানমন্ত্রী পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বলেই দেশে করোনায় মৃত্যুহার অনেক কম। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি এক লাখ কোটি টাকারও বেশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন লাল-সবুজ পতাকা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুকে কোনোদিন মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বিশ্বের অর্থনীতি যখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি, উন্নয়নখাত বিপর্যস্ত, তখন আমাদের প্রবৃদ্ধি নির্ভর বাজেট করা উচিত হয়নি। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। করোনার মধ্যেও এন-১৯ মাস্কসহ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সংবিধান না পড়ে বাজেট প্রণয়ন করলে নানা ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কৃষি খাতে ভর্তুকি যাতে কৃষকরা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার অনেক বেড়ে যাবে। সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
বিএনপির হারুনুর রশীদ প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা করে বলেন, এমন সময় করোনার আঘাত এসেছে যখন রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতি ছিল মারাত্মক দুর্বল। চিকিৎসাসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন মূল চ্যালেঞ্জ। সুশাসন ও সমন্বয়ের খুবই অভাব রয়েছে। সরকার যে বাজেট দিয়েছে, তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা আছে কি না সন্দেহ। করোনা-উত্তর দেশের অর্থনীতিকে সামাল দিতে যে ধরনের বাজেট দরকার ছিল, তা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। উন্নয়নের পরিবর্তে মানুষ বাঁচাও রাজনীতি করতে হবে। ব্যাংক লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, শেয়ারবাজার লুটেরারা সরকারের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় চরম ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
এমপি হারুন আরও বলেন, জাতীয় এই সংকট মোকাবিলায় অবশ্যই জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এসময় তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলেও আখ্যা দেন।
সময় শেষ হয়ে গেলে বিএনপির এই এমপি অতিরিক্ত সময় দাবি করলে স্পিকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন বলায় এ শব্দগুলো এক্সপাঞ্জ করে বলেন, ’আপনি (হারুনুর রশীদ) যে দু’জনের (খালেদা জিয়া-তারেক রহমান) সঙ্গে ঐক্যের কথা বলেছেন, তারা দু’জনেই আদালতে দণ্ডিত আসামি। তাদের সঙ্গে ঐক্যের কথা কিভাবে বলেন?’
এ সময় হারুনুর রশীদকে ফ্লোর দিলে তিনি স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি স্পিকারের আসন থেকে আমাদের সভাপতির নামে এসব কথা বলতে পারেন না। এর প্রতিবাদে আমি সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলাম।’ এরপর তিনি সংসদ অধিবেশন থেকে চলে যান।
বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বিএনপির হারুনুর রশীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি কীভাবে বিরোধী দল হয়? সংসদে সাংবিধানিকভাবে বিরোধী দল একমাত্র জাতীয় পার্টি। উনারা সরকারি নাকি বিরোধী নাকি জঙ্গিদের দল, তা তাদের বোঝা উচিত। তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত আসামিদের নাম উচ্চারণ করেন এই সংসদে। এসব সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে এমপি হয়েও আমার ছেলেকে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয়। সারাদেশে নির্যাতন চালায়। সেই দলের এমপিরা সংসদে এসে বড় বড় কথা বলেন।
জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রস্তাবিত বাজেটকে ’আশাবাদী বাজেট’ আখ্যা দিয়ে বলেন, দেশের অর্থনীতি এখনো শক্তিশালী, এখনো মজবুত। তবে করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হতে আরও ছয় মাস সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই সুযোগে ইয়াবা, ক্যাসিনো, অস্ত্র, চোরাচালান ও দুর্নীতির টাকা সাদা হবে। এই সুযোগ দিলে বর্তমান সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত করার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে। এতে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। কিন্তু আমাদের বাজেটে এই টাকা কিছুই না। তবে কেন দুর্নীতিবাজদের সুযোগ দেবো?
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু এক অভিন্ন নাম। ৭১ বছর বয়সী আওয়ামী লীগকে ২৬ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর ৪০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশের স্বাধীনতার জন্য ৪ হাজার ২৬৮ দিন কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। তাকে হত্যার পর খুনি জিয়াউর রহমানরা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অনেক চেষ্টা করেছে। তার কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৯ বার হামলা করা হয়েছে। সব মন্ত্রী-এমপি যদি সততার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ক্লান্তিকর প্রচেষ্টায় সহযেগিতা করেন, তবে দেশ অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে।
এমপি হারুন এমপি হারুনুর রশিদ ওয়াকআউট ডেপুটি স্পিকার বাজেট আলোচনা বিএনপির সংসদ সদস্য সংসদ অধিবেশন