প্রাস্তাবিত বাজেট গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে
২৪ জুন ২০২০ ১২:১৩
ঢাকা: ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বাজেটে গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষিখাতে আরও বেশি বরাদ্দ থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন তারা। সেইসঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার, কৃষকদের ঋণ প্রদান ও বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের সঠিক ব্যবহার হলে গ্রামীণ অর্থনীতি কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে বলে তাদের মত। তবে অর্থনীতিবিদরা এও মনে করেন, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার সময় এখন নয়। বরং এখন সেটাকে যেকোনো মূল্যে সচল রাখার সময়। এছাড়া শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও বিদেশ থেকে আসা শ্রমিকদের এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবীদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এ বাজেট গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্যে কতটুকু কার্যকর তা বলা মুশকিল। বাজেটে কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে কৃষিখাতের বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। খাতটিতে আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল। এছাড়া গ্রামকে ঘিরে যেসব প্রকল্প রয়েছে সেখানে দুর্নীতি রয়েছে; স্থানীয় সরকার পর্যায়ে যেসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেসব বরাদ্দের যেন সঠিক ব্যবহার হয়। সবমিলিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এ বাজেট মোটামুটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবারের বাজেটে কৃষিখাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। চাহিদা চাঙ্গা করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এবারের বাজেট ঠিক আছে। কিন্তু যারা শহরে ছিলেন তাদের অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন, তাদের কাজ নেই, গ্রামের ছোট ও মাঝারি শিল্পকে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসএমই’র বেশিরভাগ উদ্যোক্তা গ্রামীণ নারী। তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু এই ঋণ পেতে তাদের অনেক চ্যালেঞ্জের কথা শুনছি। অনেক উদ্যোক্তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আগে ঋণ নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে কি না। মহিলা উদ্যোক্তারা কিন্তু সমস্যায় পড়েই এবার ঋণ নিতে চাচ্ছেন।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘৫ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে এবারের বাজেটে। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা যেন ঠিক থাকে, প্রকৃত কৃষক যেন এই ঋণ পান।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাজেটে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে ভালোভাবে তা কার্যকর হলে গ্রামীণ অর্থনীতি কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে। তবে এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। প্রকল্প বা উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে। চাহিদা সৃষ্টি করতে হলে ঋণ সহায়তা আরও কার্যকর করতে হবে।’
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যায়লের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবীদ জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকে কর্মসংস্থানহীন হয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। তাদের সহায়তা দেওয়াটা বড় বিষয়। আর কৃষিখাতকে সচল রাখতে হবে। কৃষিখাতে বরাদ্দ বেড়েছে, যান্ত্রিকীকরণে বরাদ্দ বেড়েছে। সেইসঙ্গে কৃষক যাতে ফসলের দাম পায় তাও নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিখাতকে সচল রাখা এবং যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে রেমিট্যান্সের ওপর বড় প্রভাব পড়েছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রথম আট মাসে ভালো রেমিট্যান্স ছিল বলে পরের চার মাসে বিষয়টি চোখে পড়েনি। কিন্তু এই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এটি আরও প্রকট হতে পারে। ফলে যারা কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নের জন্যে এমপিদের ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এগুলো আসলে কতটুকু গ্রামীণ অর্থনীতির কাজে আসে? অনেক বছর ধরেই কিন্তু এটি চলে আসছে, এই অর্থগুলো যায় কোথায়? এর সদ্ব্যবহার হয়েছে কিনা তার মূল্যায়ন কিন্তু আমরা দেখছি না। এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা এ বছরের বিষয় নয়। এ বছরের বিষয় হলো টিকিয়ে রাখা। মহামারি যাতে গ্রামে না ছড়ায়। কৃষিপণ্যের বিপণনে সমস্যা দেখা দিয়েছে, রেমিট্যান্সে সমস্যা। কাজেই চাঙ্গার বিষয়টি ভাবার সময় এখন নয়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতোমধ্যেই যে অভিঘাত এসেছে তা মোকাবিলা করার সময় এখন।’
তার মতে, বাজেটের উদ্দেশ্য ঠিক আছে, পদক্ষেপও ঠিক আছে, কিন্তু তার সঠিক বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সামনের কোরবানি ঈদে গরু-ছাগল পালনকারী কৃষক যাতে মার না খায় সে ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। গরু-ছাগলে লাভ না হোক, অন্তত বিনিয়োগ যেন উঠে আসে তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ই-কমার্স সহায়ক হতে পারে, তবে তাতেও সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়কে ১৫ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা বেশি। বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিখাতে ভতুর্কিও বেড়েছ। এবার কৃষিখাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া কৃষকদের ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে ৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি, মৎস ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য নিরাপত্তা খাতে ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ২১ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। কৃষিখাতের এই বরাদ্দকে অর্থনীতিবিদরা দেখছেন ইতিবাচক হিসেবে। বলছেন, এতে কৃষিখাতে কিছুটা হলেও গতি সঞ্চার হবে।
সেইসঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছর যা ছিল ৩৭ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, করোনার মধ্যেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ গ্রাম ও শহরে চলছে, যা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া প্রতিটি গ্রামে পল্লী অর্থনীতি সচল ও পল্লী জনজীবনের সুবিধা ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখতে বেশকিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হচ্ছে— গ্রামীণ সড়কে পরিবর্তন, ব্যস্ত গ্রামীণ সড়কসমূহ ডাবল লেনে পরিবর্তন ও আপগ্রেডেশন করা, নির্মিত অবকাঠামোসমূহে টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ এবং সড়ক যোগাযোগবিহীন গ্রামে দ্রুত সড়ক স্থাপন করা। এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, যা গ্রাম পর্যায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানে সরাসরি প্রভাব ফেলে।