করোনায় বদলে যাওয়া বাংলাদেশ
২৫ জুন ২০২০ ১৮:০২
বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলছে৷ ফলে দেশে সকল কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। লকডাউনে বন্দী হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। করোনা পূর্বের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য৷ এ যেন এক না চাওয়া পরিবর্তিত বাংলাদেশ। করোনায় বাংলাদেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এক নেতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যা দেশ ও জাতির জন্য হুমকি স্বরূপ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। রফতানি ও প্রবাসী ক্ষেত্রে আয় কমেছে ব্যাপকভাবে। গত বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে এই বছরের এপ্রিল মাসের অর্থবছরে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ৮৩ শতাংশ।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাসে দেশের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ সময় আয় হয় মাত্র ৫২ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে এই আয় ৮২ দশমিক ৮৫ কোটি ডলার কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৮৫.৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এই সময় আয় ছিল ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার।
আবার এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ নেমে দুই কিংবা তিন শতাংশ হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সকল ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকছে। ফলে তারা আশানুরূপ আয় করতে পারছে না। বড় বড় শিল্প কারখানা বন্ধ থাকার কারণে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালিক তার থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আবার করোনার কারণে অনেক পেশাজীবী চাকরি হারাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, করোনায় রাজনীতির চিত্র অনেক বদলে গেছে। বর্তমানে রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে। নেতারা তাদের কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন স্কাইপি, গুগল মিট বা জুম অ্যাপ এর মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও এর বাইরে নয়। সবাই যার যার অবস্থানে নিরাপদ থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকারদল ও বিরোধীদলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা মাঝে মাঝে সংবাদ সম্মেলন করলেও সেটা বিশেষ ব্যবস্থা রেখে করছেন। এখন আর কোনো রাজনৈতিক মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি হয় না। আগের মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেই কোনো আমেজ। বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও তাদের মূল্যবান বক্তব্য সবার মাঝে পৌঁছে দিচ্ছেন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এ যেন এক অন্যরকম রাজনীতি।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও এসেছে এক নেতিবাচক পরিবর্তন। বছরের শুরুতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীরা তদের এক বছরের একটি পরিকল্পনা করে নেয় যে কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হবে। ঠিক তেমনি এই বছরের শুরুতেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে রেখেছিল শিক্ষা অঙ্গনের সকলেই। কিন্তু করোনা সকলের সেই লক্ষ্যকে স্থবির করে দিল।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় মার্চ মাসের শুরুতে। স্থগিত হয়ে যায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২০। শিক্ষার্থীরা একটি ঘোরের মুখে পড়ে গেছে কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির সময়সীমা বেড়েই চলছে। যার ফলে পরীক্ষা অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার সঠিক সময়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও করোনার কারণে ফলাফল প্রকাশিত হয় ১ মাস পরে। আবার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেও এখনো শুরু হয়নি উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি কার্যক্রম।
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও প্রযুক্তির স্বল্পতার কারণে কোনো কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। ফলে একাংশ শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ছে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকরা জানান, ‘করোনায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের উপর’।
প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বাসার চেয়ে স্কুলে শিখে বেশি। তাদের সবচেয়ে আনন্দের জায়গা হচ্ছে স্কুল। সকালে নিয়ম করে স্কুলে যাওয়া, বাড়ি ফেরা, পড়তে বসা ইত্যাদি সব এখন অনিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে শিশুরা তাদের শিক্ষা ভুলতে শুরু করেছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তদের সময়ের এক বড় অংশ ব্যয় করছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
মানুষের কাজ-বিনোদন-ভ্রমণ বিষয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, নেতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে সেগুলাতে। মানুষ এখন সভ্য জাতির মতোই একজন থেকে আরেকজন নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দ্রব্য ক্রয় করছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। করোনার আগেও বিভিন্ন উৎসবে বিনোদন বলতে ছিল নাচানাচি, জোরে গান বাজানো, বাজি ফোটানো ইত্যাদি। কিন্তু করোনার কারণে মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন চলে এসেছে। এখন উৎসবে নেই সেসব, সামাজিক দূরত্ব ও সকলের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই সবকিছু পালিত করছে। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে লকডাউন উঠে গেলে তখন আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায় কিনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন থাকুক বা উঠে যাক আমরা যেভাবে চলাফেরা করি, কেনাকাটা করি, বেড়াতে যাই, কাজ করি, পড়াশুনা করি- সবকিছুই আমূল বদলে দিতে যাচ্ছে করোনাভাইরাস।
করোনায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প। বাংলাদেশের প্রায় সকল পর্যটন কেন্দ্র এখন বন্ধ। দীর্ঘ তিন মাস ধরে প্রায় শূন্য বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। করোনার কারণে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে দর্শনীয় স্থানগুলোতে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে ‘মৃত প্রায়’ পর্যটন শিল্পে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ খাত সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী এখন বেকার।
না চাইলেও চলে এসেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলো। ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক পরিবর্তনই বেশি। এই নেতিবাচক পরিবর্তনের উপেক্ষা করে উঠতে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হবে। যা বাংলাদেশ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব হবে না। সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা ফিরে পাবো পুরাতন বাংলাদেশকে কিছু নতুন ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে।
লেখক: শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়