রুচির প্রশ্নে দায় কি শুধু দেশি প্ল্যাটফর্মের?
২৬ জুন ২০২০ ১২:৫৮
ঢাকা: গ্রামীণফোন (জিপি) ও রবি’র প্ল্যাটফর্ম ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ওয়েব সিরিজের নামে সেন্সরবিহীন ‘কুরুচিপূর্ণ’ ভিডিও কনটেন্ট ওয়েবে আপলোড ও প্রচারের বিষয়ে অপারেটর দুইটির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, অপারেটর দু’টির প্ল্যাটফর্ম (বায়োস্কোপ ও বিঞ্জ) ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ওয়েব সিরিজের নামে সেন্সরবিহীন নগ্ন, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য, কাহিনী ও সংলাপ সংবলিত ভিডিও কনটেন্ট প্রচার করা হয়েছে।
দেশীয় প্ল্যাটফর্মের উদ্যোক্তা ও নির্মাতারা বলছেন, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, হইচই, হটস্টার, উলু বা জি ফাইভের মতো ওয়েব কনটেন্টের বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলোতেও একই ধরনের কনটেন্ট প্রচারিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কেবল দেশীয় প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে তারা দেখছেন বৈষম্য হিসেবে।
উদ্যোক্তারা আরও বলছেন, বিজ্ঞাপন, নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য ওয়েব কনটেন্টই ভবিষ্যৎ। এই প্ল্যাটফর্মেই তৈরি হতে পারে হাজার কোটি টাকার বাজার। আর কোনো কনটেন্টের জন্যে সমালোচনা হতে পারে, তবে তার জন্যে ব্যাখ্যা চাওয়া সমীচীন নয়। একইসঙ্গে রুচির প্রশ্নে কেবল দেশীয় প্ল্যাটফর্মেরই দায় রয়েছে কি না— এমন প্রশ্নও তাদের।
আরও পড়ুন- ওয়েব সিরিজ: জিপি ও রবি’র কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়
‘কুরুচিপূর্ণ’ কনটেন্ট প্রচার নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিক্যাশন্স মোহাম্মদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে এ ধরনের কোনো কনটেন্ট প্রচারিত বা প্রকাশিত না করার ব্যাপারে আমরা সবসময় সতর্ক থাকি। এ ব্যাপারে আমাদের পার্টনারদেরও নিয়মিতভাবে সতর্ক করা হয়। দেশের সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে গ্রামীণফোন সবসময়ই সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল। অশ্লীল ও নীতিবিরুদ্ধ কোনো কনটেন্টের ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই কঠোর।
রবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি এখনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পায়নি। চিঠি পেলে উত্তর দেওয়া হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটির একটি সূত্রের দাবি, ওয়েব সিরিজের সঙ্গে রবির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
জানতে চাইলে বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার গাউসুল আলম শাওন সারাবাংলাকে বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নিজেই পরিষ্কার নয়। নিজের গা বাঁচানোর জন্যে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের কোনো গবেষণা নেই, পড়ালেখা নেই। আমাদের সংস্কৃতি কি এত ঠুনকো? ওয়েবের দুয়েকটা সিরিজ খারাপ হতে পারে, সবগুলো তো খারাপ নয়। আর ওয়েব হচ্ছে পৃথিবীর ফিউচার। বিশ্বে ৩৫ কোটি বাঙালি। আর ঢাকা থেকেই ওয়েব রেভ্যুলেশন হতে পারে। হাজার কোটি টাকার শিল্প হতে পারে। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় যদি প্রথমেই এই শিল্পে এভাবে কুড়াল মারে, আমার বলার কিছু নেই।
তিনি বলেন, নেটফ্লিক্সসহ দেশি-বিদেশি প্ল্যাটফর্ম থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ তাদের তো বৈধতা দেওয়াই হয়েছে। আর সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই তো বয়স অনুযায়ী কনটেন্ট ভাগ করা থাকে। কোন বয়সের কে কী দেখতে পারবে, সেটা আলাদা করা আছে। সবার জন্য তো সব কনটেন্ট না। আর আজ যদি ওয়েবে ১৮+ কোনো চ্যানেল হয় এবং তাতে যদি কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই আলাদা কনটেন্ট তৈরি হয়, তাতে সমস্যা কোথায়? আর রুচির প্রশ্নের দায় কি শুধু দেশি প্ল্যাটফর্মের?
বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা সারাবাংলাকে বলেন, ওয়েব আমাদের ফিউচার। যারা এই প্ল্যাটফর্মের জন্যে নির্মাণ বা প্রচার করবে, সবকিছু দায়িত্বের সঙ্গে করতে হবে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করতে হবে। তথ্য মন্ত্রণালয়কেও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এটা আমাদের ভবিষ্যৎ।
তিনি বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের এমন ব্যাখা চাওয়ার কারণে ওয়েব কনটেন্ট তৈরির প্রবণতা সংকুচিত হতে পারে, ওয়েব কনটেন্টে বিনিয়োগ সংকুচিত হতে পারে। সেটা খুব একটা ভালো কিছু হবে না। তাই কনটেন্ট খারাপ হলে সমালোচনা হতে পারে। আর ওয়েবে এখনো আমাদের দেশীয় প্ল্যাটফর্ম তৈরিই হয়নি। এরকম হলে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হওয়ার আগেই মুষড়ে পড়বে।
চলচ্চিত্র অভিনেতা ও অভিনয় শিল্পী ইরেশ যাকের সারাবাংলাকে বলেন, ভালো কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনা হওয়ার কথা না। আমরা যদি ভালো কনটেন্ট বানাই, তাহলে এমন সমালোচনা হবে না। তবে আমি একটু কনফিউজড, কেন বায়োস্কপের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। যে ওয়েব সিরিজগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার কোনোটিই বায়োস্কোপ থেকে প্রচারিত হওয়ার কথা নয়। বায়োস্কোপের কাছে তথ্য মন্ত্রণালয় কেন ব্যাখ্যা চেয়েছে, তা আমি জানি না। আর রবির বিঞ্জের বেশকিছু কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনা হয়েছে— সেটা আমিও জানি। আমরা নিজেরাও এমন কনটেন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছি।
তিনি বলেন, কন্টেন্টের ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই নিজেদের রেগুলেট করব। এমন কিছু করব না যেন আমাদের ক্ষতি হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে গ্রামীণফোন ও রবির কাছে কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার খবর প্রচারের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে দেশীয় লাইভ স্ট্রিমিং একটি অ্যাপের উদ্যোক্তা লিখেছেন, ‘এখনো প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেল না… নেটফ্লিক্স/ অ্যামাজন/ হই চই/ জি ফাইভের কাছে এই ধরনের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে কবে?!’
সংশ্লিষ্ট এক উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, অনলাইনে বিদেশি বিনোদনধর্মী প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। দেশি প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের সঙ্গে নানা কারণেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না। তারা সবকিছুই প্রচার করতে পারছে, কোনো বাধা নেই। কিন্তু দেশি প্ল্যাটফর্মগুলোকেই একটি মহল টার্গেট করছে।
ফেসবুক, গুগলের মতো দেশে বিনোদনধর্মী বিদেশি কোনো প্ল্যাটফর্মের নিবন্ধিত অফিস নেই। নানাভাবেই তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কনটেন্ট মেকার ও টম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিয়াউদ্দিন আদিল সারাবাংলাকে বলেন, যেহেতু দেশি কোম্পানিগুলো দেশি ট্যাক্সের অন্তর্ভুক্ত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যেকোনো সময় যেকোনো ট্যাক্স ফাইল, ভ্যাট ফাইল বা যেকোনো কিছু দেখতে চাইলে দেখতে পারে। সে অনুযায়ী তারা তাদের রাজস্বও আহরণ করতে পারে। এটা কেবল দেশি কোম্পানি বলেই সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়। কিন্তু বিদেশি কোম্পানি যারা আছে, তারা ব্যবসা করলেও তাদের কোনো নিবন্ধিত অফিস থাকে না, কিছুই থাকে না। তারা তাদের কনটেন্ট দেখিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে তাদের ব্যবসাটা করে চলে যায়। কিছু ট্যাক্স পে করতে হলে সেটাও আমাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া হয়। এটা আমার কাছে মনে হয় এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা। এটাতে সরকারের একটি সমন্বয় করা দরকার— নীতিটা যেন সবার জন্য সমান থাকে।
অমিতাভ রেজা ইরেশ যাকের ওয়েব কনটেন্ট ওয়েব সিরিজ গাউসুল আলম শাওন গ্রামীণফোন জিয়াউদ্দিন আদিল বায়োস্কোপ বিঞ্জ রবি