ঝুলে গেছে ওয়ারীর লকডাউন!
২৭ জুন ২০২০ ১৪:৩১
ঢাকা: কার্যকর হচ্ছে-হবে বলতে বলতেই ঝুলে গেছে রেড জোন চিহ্নিত রাজধানীর ওয়ারী এলাকার লকডাউনের সিদ্ধান্ত। ওয়ারী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন হওয়ায় রেড জোন চিহ্নিত করে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে এলাকাটি লকডাউনের নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফর। তবে এ নির্দেশনা পাওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে ডিএসসিসির দাবি ছিল এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং পেলেই লকডাউন কার্যকর করা হবে।
কিন্তু দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছ থেকে এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং পাওয়ার পরও লকডাউন কার্যকরে ডিএসসিসির নেই কার্যকরী কোন উদ্যোগ। উল্টো এখন ডিএসসিসির দাবি, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ম্যাপ পেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকরের নির্দেশনা পায়নি সংস্থাটি। কিন্তু সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা এতদিন যে দাবি করে এসেছিলেন, ‘ম্যাপ পেলে লকডাউন কার্যকর করা হবে, ম্যাপ পাওয়ার ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যেই লকডাউন কার্যকর হবে কিংবা লকডাউন কার্যকরে প্রস্তুত ডিএসসিসি’ তাহলে এসব কেনো বলেছিল? জানতে চাইলে মেলেনি এসবের উত্তর।
গত ১৫ জুন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহ মো. এমদাদুল হক সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘আমরা লকডাউনের একটি নির্দেশনা পেয়েছি। তবে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জানিয়েছি এলাকাভিত্তিক ম্যাপ দেওয়ার জন্য। এলাকাভিত্তিক ম্যাপ দিলে আমরা লকডাউন কার্যকর করব। তারাও জানিয়েছে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেবে আমাদেরকে।’
এর পরদিন ১৬ জুন ডিএসসিসির নগর ভবনে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জোনিং সিস্টেম বাস্তবায়ন বিষয়ক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, রেড জোনের এলাকা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট নকশা পেলে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লকডাউন কার্যকর করা হবে।
সর্বশেষ গত ২৩ জুন সকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সাংবাদিকদের ডিএসসিসি মেয়র তাপস বলেছিলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন পাওয়ার সাথে সাথেই লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে এবং পরের দিনই আমরা কেন্দ্রীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয় সভা করেছি। আমরা আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছি। এখন আমরা এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর লকডাউন বাস্তবায়নে এরইমধ্যে ঘোষিত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময়ের আগেই তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
মেয়রের এমন বক্তব্যের পরের দিন অর্থাৎ ২৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এলাকাভিত্তিক ম্যাপি পাঠানো হয়েছে বলে সংস্থাটির সিইও সারাবাংলাকে ওইদিন নিশ্চিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ম্যাপিং পাওয়ায় পরদিন বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) সকালে নগর ভবনে সভাও ডাকা হয়েছিল লকডাউন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। কিন্তু বুধবার রাতেই সভাটি স্থগিত ঘোষণা করে ডিএসসিসি। এতে ওয়ারী এলাকা লকডাউন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত এখন ঝুলে আছে। সেই সঙ্গে ঝুলে আছে রেডজোন চিহ্নিত ডিএসসিসির আরও ২৮টি এলাকাও। এসব এলাকায় আদৌ লকডাউন হবে? নাকি হবে না সে বিষয়েও দায়িত্বশীলরা কিছু বলতে পারছেন না।
এ বিষয়ে জানতে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে কল করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
পরে ডিএসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. এমদাদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ম্যাপিং পেয়েছি এটি ঠিক আছে। কিন্তু শুধু ম্যাপিং পেলেই তো লকডাউন করা যাবে না। আমাদেরকে তো সরকার নির্দেশ দিতে হবে। আমরা এখনও সরকারের নির্দেশ পায়নি।’
তাহলে এতদিন যে বলে আসছিলেন এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং পেলেই লকডাউন কার্যকর করবেন এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি। ফের বললেন, সরকার থেকে নির্দেশ পেলেই বাস্তবায়ন করবেন। তবে সরকার বলতে কোন মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট বরে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজাবাজার এলাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ওয়ারী এলাকা লকডাউন করার নির্দেশনা দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। আদেশটি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রেদের কাছে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে।
ওই আদেশে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে অবিলম্বে তিনটি জেলা (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী) এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজাবাজার এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারীতে পরীক্ষামূলকভাবে জোনিং সিস্টেম বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হবে। জোন সুনির্দিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন অংশে কার্যকর হবে এবং এর পরিধি কী হবে, তা প্রয়োজন অনুসারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে।
তবে এ আদেশের চিঠি পাওয়ার পর ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় পরীক্ষামূলক লকডাউন কার্যকর করলেও বিষয়টি আমলে নেয়নি ডিএসসিসি। পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউনের ১৯ দিনও পার হয়ে গেছে এবং লকডাউনের ফলে এলাকাটিতে সংক্রমণ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে সংক্রমণের হার ছিল ১৯ শতাংশ। দ্বিতীয় সপ্তাহে ছিল ৯ শতাংশ। আর তৃতীয় সপ্তাহে ২- ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করছে ডিএনসিসি।
আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব রাজাবাজার বাজারে লকডাউনের আগে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৯ জন। আর লকডাউনের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৪০ জন। বর্তমানে মোট আক্রান্ত ৭৯ জন। আর ওয়ারী এলাকায় বর্তমানে ২৪ জুন পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী মোট আক্রান্ত ১৫৮ জন। দুই সিটির এলাকা ভিত্তিক জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে পূর্ব রাজাবাজার এবং ওয়ারী লকডাউনের আদেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমন আদেশের পর গত ১৩ জুন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওই দুই এলাকাসহ আরও ৪৩টিসহ মোট ৪৫টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে করোনা প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় টেকনিক্যাল কমিটি। এরমধ্যে দক্ষিণ সিটির ২৮টি ও উত্তর সিটিতে পড়েছে ১৭টি এলাকা। এসব এলাকায় লকডাউন বাস্তবায়ণে ১৭ জুন রাতে ঢাকার দুই মেয়রদের সঙ্গে বৈঠকে করে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। বৈঠকে এক সপ্তাহের মধ্যে লকডাউন কার্যকরে মানসম্মত কার্য পদ্ধতি (এসওপি) মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন মন্ত্রী।
কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি সময় হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি এখনও জানা যায়নি।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওয়ারীতে লকডাউন কার্যকরের বিষয়ে ডিএসসিসিকে নির্দেশনা দেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নির্দেশনা পেলে সেটি বাস্তবায়ন করবে ডিএসসিসি। কিন্তু ডিএসসিসি তো এখনও নির্দেশনা পায়নি।’
রেড জোন চিহ্নিত রাজধানীর ৪৫টি এলাকায় লকডাউনের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটির জন্য মেয়রদেরকে এসওপি তৈরি করে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেগুলো পেলেই তবে বলা যাবে।’
সেগুলো জমা দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছিল। সময় তো শেষ। তবে কী আরও সময় বাড়ানো হয়েছে প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে কল কেটে দেন।