রাখাইনে ফের সেনা-আতঙ্ক, ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ
২৯ জুন ২০২০ ০৩:০৬
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনীর ‘শুদ্ধি অভিযান’ পরিচালনার ব্যাপারে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষকে মন্ত্রণালয়ের তরফে সতর্কবার্তা দেওয়ার পর, সেনা-আতঙ্কে হাজার হাজার গ্রামবাসী ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
রাখাইন রাজ্যের একাধিক আইনপ্রণেতা ও মানবাধিকার সংস্থার বরাতে এ খবর জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
তবে, দেশটির সরকারি মুখপাত্র বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সীমান্ত বিষয়ক কর্মকর্তারা রাখাইনে এক উচ্ছেদ আদেশ জারি করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
শনিবার (২৬ জুন) মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হতাই ফেইসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, সরকারের তরফ থেকে সামরিক বাহিনীকে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
এদিকে, মিয়ানমারের সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই আদেশ জারির বিষয়টি স্বীকার করলেও এর প্রভাব অল্প কয়েকটি গ্রামে পড়েছে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের কাছে দাবি করেছে।
এর আগে, বুধবার (২৪ জুন) সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লেখা একটি চিঠিতে গ্রাম প্রধানদের সেনা অভিযানের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। ওই চিঠির কপি রয়টার্সের হাতে এসে পৌঁছেছে এবং রাখাইন রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রী কর্নেল মিন থানের মাধ্যমে তা যাচাই করা হয়েছে।
পাশাপাশি, রাখাইন রাজ্যের রাথেডাং পৌরসভার প্রশাসক অং মাইন্ট থেইনের সই করা চিঠিটিতে গ্রাম প্রধানদের বলা হয়েছে, পৌরসভাধীন কায়ুকতান গ্রাম ও এর নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এমন সন্দেহে সেখানে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে সেনাবাহিনী। কিন্তু, অভিযানের আদেশটি কোথায় থেকে এসেছে চিঠিটিতে তার উল্লেখ নেই।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী মিন থান রয়টার্সকে জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয় থেকেই নির্দেশটি দেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে, মিয়ানমার সরকারের যে তিনটি মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে আছে তার একটি হলো নিরাপত্তা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এছাড়াও ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গ্রামগুলোতে শুদ্ধি অভিযান চালাবে। অভিযান চলাকালে আরাকান আর্মি (এএ) সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যদি লড়াই শুরু হয় তাহলে গ্রামে না থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে থাকবেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, সেনা অভিযানের আশঙ্কায় কায়ুকতান গ্রাম থেকে অন্তত ৮০ জন রাথেডাং পৌরসভার অন্য এলাকায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন মিন থান। সেনাবাহিনী তাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মানবাধিকার গোষ্ঠী রাখাইন এথনিক কংগ্রেসের (আরইসি) সম্পাদক জ জ হতুন জানিয়েছেন, অন্তত এক হাজার ৭০০ জন পার্শ্ববর্তী পন্নাগিয়ুন পৌরসভায় পালিয়ে গেছে। আরও এক হাজার ৪০০ জন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে এবং তারা তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে বলে রাথেডাং পৌরসভা থেকে রয়টার্সকে জানিয়েছেন পার্লামেন্টের স্থানীয় প্রতিনিধি ওও থান নায়িং।
অপরদিকে, ওই আদেশ জারির পর থেকে কায়ুকতান ও এর আশপাশের ৩৯ গ্রামের বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু করেছে বলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক (বিএইচআরএন) জানিয়েছে। কায়ুকতান এলাকায় রোহিঙ্গা, রাখাইন জাতিগোষ্ঠিসহ প্রায় লাখখানেক মানুষ বসবাস করে বলে জানিয়েছে আরইসি।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করছে। মূলত রাখাইনের বৌদ্ধ নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি। এই দুই পক্ষের লড়াইয়ে এ পর্যন্ত বহু বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
উল্লেখ করা যায় যে, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠিকে লক্ষ করে পরিচালিত অভিযানকে বর্ণনা করতেও ‘শুদ্ধি অভিযান’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছিল মিয়ানমারের সরকারি কর্তৃপক্ষ। ওই অভিযানের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় পালিয়ে এসে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ইতোমধ্যেই, কয়েকদফা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবে তা আলোর মুখ দেখেনি।