Wednesday 09 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শততম বর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


১ জুলাই ২০২০ ০৪:২৩ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ০১:০১

ফাইল ছবি

‘বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্প্লেনডিড ইম্পেরিয়াল কমপেনসেশন। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।’— ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে ঠিক এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি বর্ণনা করেছেন।

বিজ্ঞাপন

উপমহাদেশের রাজনীতির এক বাঁকবদলের সময় জন্ম নেওয়া সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি (ঢাবি) ৯৯ বছর পেরিয়ে আজ বুধবার (১ জুলাই) শততম বর্ষে পা রেখেছে। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন মাহেন্দ্রক্ষণটি অবশ্য জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপনের কোনো সুযোগ থাকছে না। বরং করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি পরিস্থিতিতে ১০৩ দিন ধরে বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ যে শিক্ষার্থী, তাদের পদচারণাশূন্য ফাঁকা ক্যাম্পাসেই কাটবে দিনটি।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখেই স্বল্প পরিসরে এ বছরের এই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। উড়ানো হবেবেলুন।

পরে সকাল ১১টায় অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনলাইন ভার্চুয়াল মিটিং প্ল্যাটফর্ম জুমের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সংযুক্ত হয়ে ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গ : আন্দোলন ও সংগ্রাম’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদর্পণের এই দিনটি উদযাপন প্রসঙ্গে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুজিববর্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম জন্মবার্ষিকী একই সালে হওয়ায় এর আলাদা একটি তাৎপর্য রয়েছে। তবে করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে পারছি না আমরা। সংক্ষিপ্তভাবে স্বল্প পরিসরেই এবারের আয়োজন সাজানো হয়েছে।’

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং অন্য নেতারা। এরই প্রেক্ষিতে গঠিত হয় নাথান কমিশন। কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ইতিবাচক রিপোর্ট দিলে ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এই দিন থেকেই মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯২১ সালের পহেলা জুলাই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার পি জে হার্টজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনের যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তারও অনেক আগে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই পহেলা জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত তিনি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছিলেন।’

আন্দোলনসংগ্রামের গৌরবজ্জ্বল ঐতিহ্য

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ— এই অঞ্চলের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে প্রায় প্রতিটি আন্দোলনেই ওতপ্রোতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীসহ অনেকে শহিদ হয়েছেন।

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা দেখি, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা আজ গর্বভরে বলতে পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।’

বাতিঘর যখন সংকটের আবর্তে

তিনটি অনুষদের অধীনে ১২টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আবাসিক হলের সংখ্যা ছিল তিনটি। ৮৭৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে সেসময় শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬০ জন। ‘শিক্ষাই আলো’ স্লোগান মাথায় নিয়ে শতবর্ষে পা রাখা প্রতিষ্ঠানটিতে অনুষদ সংখ্যা ১৩। রয়েছে ১৩ টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং শিক্ষার্থীদের ১৯টি আবাসিক হল, চারটি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৬ হাজারেরও বেশি। তাদের পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় দুই হাজার শিক্ষক।

প্রতিষ্ঠাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল সংখ্যা ছিল তিনটি। বর্তমানে হল সংখ্যা ১৯টিতে উন্নীত হলেও হলের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে আরও অনেক বেশি গতিতে। ফলে  শিক্ষার্থীরা তীব্র আবাসন সংকটের মুখে। আর সেই সংকটের কারণেই একই রুমে গাদাগাদি করে অনেক শিক্ষার্থীর বসবাসের ব্যবস্থা ‘গণরুম’ নামে বহু বছর ধরে বহাল তবিয়তে চলে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।

শিক্ষার মান, গবেষণা আর বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে তলানিতে স্থান পাওয়ার মতো বিষয়গুলোও সাম্প্রতিক কালে বহুল আলোচিত। আর এসব আলোচনায় বারবারই উঠে আসছে, শিক্ষার মান আর গবেষণায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি। দেশের বাতিঘর হয়ে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিহাসের পাতাকে বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় আজ পুঁথিগত বিদ্যাধারী গ্র্যাজুয়েট উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে বলেও অভিযোগ অনেকের।

এর পাশাপাশি বড় সমালোচনা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সসহ বেশকিছু নতুন বিভাগ নিয়ে। বলা হয়ে থাকে, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে সার্টিফিকেট বিক্রি করা হয়। এছাড়া নতুন নতুন অনেক বিভাগই খোলা হয়েছে চাকরিমুখী গোষ্ঠী তৈরি করার উদ্দেশে, যেখানে জ্ঞান অর্জনের চেয়ে চাকরির যোগ্যতা অর্জনই মুখ্য।

‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই শিক্ষায়তনে গবেষণার প্রবণতা যে কমছে, সেটি দৃশ্যমান নানাভাবেই। গবেষণালব্ধ ফল যেমন সাম্প্রতিককালে মিলছে না, তেমনি বছর বছর গবেষণায় বরাদ্দ রীতিমতো কমছেও। জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাবি’র মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিল গবেষণার জন্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ০৪ শতাংশে।

শতবর্ষে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও গবেষণা প্রসঙ্গে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নিশ্চয়ই একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়েই গর্ব করে। তবে এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। রাতারাতি হয়তো সব পরিবর্তন একসঙ্গে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তারপরও কিছু পরিবর্তন আসছে। ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগোচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংকট থাকলেও সেগুলো থেকে উত্তরণে আশাবাদী বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। তীব্র আবাসন সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেন নেন তিনি। বলেন, শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসন ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। তবে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে এ বিষয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

শিক্ষার মান, গবেষণা ইত্যাদি বিষয়েও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান ঢাবি উপাচার্য। তিনি বলেন, আগামী বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপিত হবে। এই দুই উপলক্ষ মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে। এই পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মান উন্নয়ন ও গবেষণা কর্ম নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমাদের আছে।

আ আ ম স আরোফিন সিদ্দিক ড. আখতারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢা‌বি ঢাবি উপাচার্য ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড শতবর্ষ শতবর্ষে পদার্পণ

বিজ্ঞাপন

খুলনায় ৩ যুবককে কুপিয়ে জখম
৮ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:৫৪

আরো

সম্পর্কিত খবর