হাইড্রোজেন প্রযুক্তির ‘বিপ্লব’ আশা না আকাশকুসুম?
২ জুলাই ২০২০ ১১:০২
ঢাকা: অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, হাইড্রোজেন প্রযুক্তিই হচ্ছে সেই উপায় যেখানে ব্রিটেন সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। তিনি আশা করছেন, এর মাধ্যমেই ভবিষ্যতে তৈরি হবে ‘সুস্থ’ চাকরির বিশাল বাজার। তবে এই হাইড্রোজেন প্রযুক্তি কি সত্যি আশা দেখাচ্ছে, নাকি এ-ও কোনো আকাশকুসুম কল্পনা!
নিচের ছবিতে যে এস্কেভেটরটি দেখা যাচ্ছে, এটি আর দশটা সাধারণ এস্কেভেটরের কাজই করে। অন্য সবগুলোর মতোই মাটি কাটা, পাথর সরাতে ব্যবহার করা যায় একে। মুখোমুখি দেখতে এটি অন্যসব খনন যন্ত্রের মতোই।
কিন্তু পেছন থেকে তাকালে চোখে পড়বে ভিন্নতাটুকু। প্রচলিত এস্কেভেটরের মতো ডিজেল ট্যাংক নয়, এর বদলে এতে রয়েছে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল। বলা হচ্ছে, এটি এখন পর্যন্ত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এস্কেভেটর এবং এতে জ্বালানি হিসেবে প্রচলিত ডিজেলের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে হালকা উপাদান ‘হাইড্রোজেন’।
কেবল এই এস্কেভেটরেই নয়, জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার আরও নানা ক্ষেত্রেই বিস্তৃত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মাইক্রো-ট্যাক্সি, ট্রাক, জলযান, ভ্যান, ডাবল ডেকার বাস, এমনকি ছোট প্লেনগুলোতেও এই পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
ফুয়েল সেলে হাইড্রোজেনের সঙ্গে অক্সিজেনের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এটি বিদ্যুৎ তৈরির কাজ করে। আর এর উপজাত হিসেবে পরিবেশবিধ্বংসী কার্বনের পরিবর্তে তৈরি হয় পানি।
বলা হচ্ছে এটি একটি ‘বিপ্লব’
নানা ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন জ্বালানির ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত হওয়ায় অনেকেই বলছেন, বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘হাইড্রোজেন বিপ্লব’ আমাদের দুয়ারে। কিন্তু আসলেই কি তাই? ফিরে যাওয়া যাক ২০০০ সালের প্রথম দিকে। তখনই বলা হচ্ছিল, এই হাইড্রোজেন আগামী পৃথিবীতে পরিষ্কার জ্বালানি হিসেবে গাড়ির বাজারে রাজত্ব করবে। কিন্তু বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে সেই ‘হাইড্রোজেন হাইওয়ে’র আশ্বাস আর বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রথমত, হাইড্রোজন জ্বালানি ব্যবহারে একটি নতুন অবকাঠামো দরকার। কারণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাটারিচালিত গাড়িগুলো কাছাকাছি থাকা বিদ্যুৎস্টেশন থেকেই চলার শক্তি নিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ব্যাটারি প্রযুক্তি এখন অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। খুব ভালোভাবেই তারা কম্পিউটারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু হাইড্রোজেন এখনও পেছনে রয়েছে তাদের।
সুতরাং এটা স্পষ্ট, মোটরগাড়ির মুখোমুখি লড়াইয়ে বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি প্রযুক্তির কাছে হাইড্রোজেন হেরে গেছে। তবে নির্দিষ্ট কিছু যানবাহন ও ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক ব্যাটারি চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। সেখানে কিন্তু হাইড্রোজেন অনেক সম্ভাবনাময়।
যেমন— ‘জেসিবি’র এস্কেভেটরের কথাই ধরা যাক। জেসিবি বলছে, হাইড্রোজেনে চালিত এই এস্কেভেটরের ব্যাটারি খুবই ছোট এবং এর মাধ্যমেই যেকোনো কাজ করা সম্ভব। যদি এটা বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারির মাধ্যমে করা হয়, তবে সেই ব্যাটারির ওজন দাঁড়াবে ৫ টন!
আবার ডিজেলচালিত হলে ওজনের পাশাপাশি ফুয়েল ট্যাংক ভরতেও সময় লাগবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেখানে মাত্র দুই মিনিটেই বাতাসের চেয়েও হালকা হাইড্রোজেন ট্যাংকে ভরে ফেলা যায়। বড় লরিগুলোকেও এই খননযন্ত্রের সাথে তুলনায় আনা যায়। তাদেরও বেশি ব্যাটারির ওজন বহন করতে হচ্ছে।
একইভাবে এই তালিকায় রাখা যায় বাসকেও— বলছে বামফোর্ড পরিবার, যারা জেসিবি’র মালিক। তারা জানাচ্ছে, সম্প্রতি তাদের ‘রাইটবাস ফ্যাকটরি’ ৮০টি হাইড্রোজেনচালিত ডাবল ডেকার তৈরির কাজ পেয়েছে।
যদিও এখনো রিফুয়েলিং অবকাঠামোর সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। তারপরও এটা প্রচলিত গ্যাস স্টেশনের মতো ‘হাইড্রোজেন পাম্প’ করার মধ্য দিয়েই সমাধান করা সম্ভব বলে জানাচ্ছে তারা।
বিমানবন্দরেও হাইড্রোজেনের সংরক্ষণাগার করা সম্ভব। ক্র্যানফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৈদ্যুতিক বিমানের পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে ব্যবহার করা হয়েছিল এই হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল। সে পরীক্ষা সফলতারও মুখ দেখেছে।
জার্মানিও এই ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা হাইড্রোজেনের ফিলিং স্টেশনের অবকাঠামো এবং একটি হাইড্রোজনচালিত ট্রেন নিয়ে কাজ করছে। তারা এই সেক্টরে এরই মধ্যে ৭ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করে ফেলেছে। ইইউ কমিশনও এই কাজের ফলাফল দেখতে মুখিয়ে আছে।
বলা হচ্ছে, ব্যাটারিচালিত প্রযুক্তিতে চীনের কাছে হেরে গিয়েই হাইড্রোজেন প্রযুক্তিতে মন দিয়েছে ব্রিটেন। এইটাই তাদের ক্ষত সারানোর একমাত্র ‘উপায়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কমিটিও হাইড্রোজেন প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে ২০২০-এর শুরু থেকেই নানা পরীক্ষা হাতে নিয়েছে।
আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটেন তাদের প্রথম হাইড্রোজেনচালিত ট্রেন সাধারণ রেললাইনেই পরীক্ষামূলক চালাবে। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত।
এত সব আলোচনায় মনে হতে পারে, হাইড্রোজেন বুঝি সত্যি সত্যিই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু এমন ভাবনা খুব একটা সঠিকও নয়। কারণ প্রতিটি প্রযুক্তিরই নিজস্ব কিছু সমস্যা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে এখন যত হাইড্রোজেন বিক্রি করা হয়, তার সবটুকই তৈরি করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু এটা ব্যয়বহুল। অন্যদিকে, হাইড্রোজেন জ্বালানিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বনের নিঃসরণ না হলেও হাইড্রোজেন তৈরির এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড। অর্থাৎ হাইড্রোজেন জ্বালানির গোটা প্রক্রিয়াতে তখন পরিবেশবান্ধব ট্যাগটা কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ তো হয়ই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাইড্রোজেনের প্রোডাকশন হাব তৈরির মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। তবে তা বহু খরচার বিষয়।
তাই বিকল্প জ্বালানির এই শক্তি বিশুদ্ধ হলেও আপাতত মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়বহুল এবং সেই অর্থে এখনো বাস্তবসম্মতও নয়।
‘নির্বোধ সেল’?
তবে হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়াকেই ‘অপচয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন টেসলা কারের প্রধান এলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘এটা প্রথমে বিদ্যুতকে গ্যাসে এবং তারপর সেই গ্যাসকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার একটি আশ্চর্যজনক নির্বোধ প্রক্রিয়া।’ জ্বালানির ক্ষেত্রে হাইড্রোজেনকে তিনি ‘নির্বোধ সেল’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
তবে হাইড্রোজেনপ্রেমীরা এতসব সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনাকে গায়ে মাখতে নারাজ। তারা মনে করেন, প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই ‘মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়বহুল’ প্রক্রিয়াগুলোকে খুব অল্প খরচের বিষয়ে পরিণত করে তোলা যাবে। এর মাধ্যমেই পরিবেশ দূষণরোধী সাশ্রয়ী জ্বালানি পাবে মানুষ। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ বাতাসের স্বপ্ন এই হাইড্রোজনই সত্যি করে তুলবে।