Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা কি শুধু শ্বাসতন্ত্রের রোগ, নাকি মস্তিস্কেরও?


২ জুলাই ২০২০ ২৩:৫৭

ঢাকা: স্ট্রোক, বিকার, উদ্বেগ, হতাশা, অবসাদ— এই তালিকা বেড়েই চলছে ক্রমশ। সুতরাং কোভিড-১৯’কে কেবল শ্বাসযন্ত্রের রোগ ভাবার আগে চিন্তা করুন আরেকবার। চলতি সপ্তাহে আক্রান্তদের নানা উপসর্গ থেকে এটা দেখা যাচ্ছে যে করোনাভাইরাস শুধুমাত্র শ্বাসতন্ত্রেরই নয়, স্নায়ুতন্ত্রেরও ব্যাপক ক্ষতি করার সক্ষমতা রাখে।

তুলনামূলকভাবে হালকা অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের সবাই প্রথমে ক্লান্তি, মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তবে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে তাদের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনাও দেখা গেছে। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেগের বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

কথা হয় পল মালিরা’র সঙ্গে। ৬৪ বছর বয়সী পল কাজ করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ পরিচালক হিসেবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর দুই দুই বার স্ট্রোক হয়েছে তার।

লন্ডনের জাতীয় নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারি (এনএইচএনএন) হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, পল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যেসব আঘাত সামলে সেরে উঠেছেন, তা খুবই উল্লেখযোগ্য। যখন তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন তার প্রথম স্ট্রোক হয়। তার ফুসফুস ও পায়ে মারাত্মকভাবে তখন রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছিল। এ কারণে তাকে শক্তিশালী ‘অ্যান্টিকগুল্যান্ট’ জাতীয় (রক্ত তরল করার) ওষুধ দেওয়া হয়। এর কয়েকদিন পর তার দ্বিতীয় দফায় স্ট্রোক হয়। ফলে দ্রুত তাকে ভর্তি করা হয় কুইন স্কয়ারের ‘এনএইচএনএন’ হাসপাতালে।

পল মালিরা দুই বার স্ট্রোক করেছিলেন

পলকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে ছিলেন কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট ডা. অরবিন্দ চন্দ্রথেভা। তিনি বলেন, ‘আমি যখন পলকে প্রথম দেখি তখন তার মুখে এক ধরনের শূন্য অনুভূতি ছিল। কেবল একপাশে সে দেখতে পাচ্ছিল, আর সে মনেও করতে পারছিল না কিভাবে ফোন ব্যবহার করতে হয় বা তার ফোনের পাসওয়ার্ড কী।’

‘ধারণ করেছিলাম অন্যসব স্ট্রোকের রোগীর মতোই তারও মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার পর যা দেখলাম তা খুবই বিস্ময়কর এবং একেবারেই আলাদা। পল অন্য একধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, যার ফলে মস্তিস্কের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রক্ত দলা পাকিয়ে যাচ্ছে’, বলেন ডা. অরবিন্দ।

রিপোর্টে দেখা যায়, অবিশ্বাস্যরকমভাবে তার মস্তিস্কের অনেক রক্ত জমে আছে, যা ‘ডি-ডাইমার’ নামে পরিচিত। সাধারণ ক্ষেত্রে এই রক্তকণা জমাটের পরিমাণ ৩০০-এর কাছাকাছি, স্ট্রোকের রোগীর ক্ষেত্রে তা ১০০০-এর মতো হয়। কিন্তু পলের ক্ষেত্রে এই পরিমান ছিল ৮০ হাজার!

ডা. অরবিন্দ বলেন, ‘এই পরিমাণ জমাট রক্ত আগে কোনো ক্ষেত্রেই দেখিনি। সম্ভবত তার শরীরে করোনাভাইরাসের আক্রমণেই এমনটি হয়েছে।’

লকডাউন চলাকালেও বেশকিছু স্ট্রোকের রোগীদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে লন্ডনের জাতীয় নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারি (এনএইচএনএন) হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ছয় জন রোগী মারাত্মক স্ট্রোক করে ভর্তি হয়েছেন। করোনার কারণে সাধারণত ডায়াবেটিক বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের স্ট্রোকের সম্ভবনার কথা বলা হলেও এই রোগীদের সেসব কিছুই ছিল না। তারপরও তারা স্ট্রোক করেছেন এবং তাদের রক্তও ব্যাপক পরিমাণে জমাট বাঁধা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থার অতি প্রতিক্রিয়ার ফলে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে শরীর এবং মস্তিস্কে প্রদাহের ফলে রক্ত বেশি পরিমাণে জমাট বাঁধছে।

পলের মস্তিস্কের পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন ডা. অরবিন্দ। তিনি বলেন, ‘তার মস্তিকের যে পরিমাণ অংশ আক্রান্ত হয়েছিল তাতে বড় ক্ষতির সম্ভাবনায় ছিল। ওই সময়ে সে কোনোকিছুই ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলেন না, স্মৃতি, সমন্বয় এবং কথা বলার মতোও কাজগুলো তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এটা এত বড় ছিল যে চিকিৎসকরা তার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।’

পল বলেন, ‘দ্বিতীয়বার স্ট্রোকের পর আমার স্ত্রী ও মেয়েরা মনে করেছিল, তার আমাকে আর দেখতে পাবে না। চিকিৎসকরাদেরও অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তারপরও আমি কোনোভাবে বেঁচে ফিরেছি এবং ক্রমশই সুস্থ হয়ে উঠছি।’

করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্কের একটি অংশের স্ক্যান ইমেজ

পল ছয়টা ভাষা জানেন, আর ভাষার বিষয়টিই পলের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম চিকিৎসকদের আশান্বিত করে। তিনি ইংরেজিতে কথা খুঁজে না পেয়ে এক নার্সের সঙ্গে পর্তুগিজ ভাষায় যোগাযোগ করেছেন। ‘তিনি (পল) যৌবনে তিনি অনেকগুলো ভাষা শিখেছিলেন, যার ফলে তার মস্তিস্কে যোগাযোগের বেশকিছু আলাদা স্নায়ু গঠিত হয়েছিল। যার কারণেই পল স্ট্রোক সামলে সুস্থ হয়ে উঠছেন’,— বলেন ডা. অরবিন্দ।

ল্যানসেট মনোরোগবিদ্যার এক গবেষণায় কমপক্ষে ১২৫ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মারাত্মকভাবে স্ট্রোক করার তথ্য উঠে এসেছে। যারা মস্তিস্কে প্রদাহ, মনোরোগ ও স্মৃতিভ্রংশের মতো লক্ষণে ভুগছেন— তাদের অর্ধেকের মস্তিস্কে বড় আকারে রক্ত জমাট বাঁধার চিহ্ণ রয়েছে।

লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টম সলোমন বলেন, ‘এটা এখন স্পষ্ট যে করোনাভাইরাস ফুসফুসের পাশাপাশি মস্তিস্কেরও মারত্মক ক্ষতি করার ক্ষমতাসম্পন্ন। এটা শুধুমাত্র মস্তিস্ক প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পাওয়ার বিষয়ই নয় বরং সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার মতো ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই প্রশ্ন এখনই তোলা উচিত, এই ভাইরাস কি নিজেই ফুসফুসের মতো মস্তিস্কেও সংক্রমণ ঘটানোর মতো শক্তিশালী কি না!’

কানাডার নিউরোবিজ্ঞানী অধ্যাপক আড্রিয়ান ওয়েন কাজ করছেন করোনাভাইরাস কিভাবে মনোজগতে প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত জানি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যেসব রোগী আইসিইউ থেকে ফিরে এসেছেন, তারা স্মৃতি সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়েছেন। তাই আসিইউ থেকে তাদের বেঁচে ফেরাটা সুস্থ হয়ে যাওয়া নয়, বরং এইটা তাদের আরোগ্যলাভের শুরু বলা যায়।’

সার্স ও মার্স— করোনাভাইরাসের সমগ্রোত্রের দুই ভাইরাসও স্নায়ুতন্ত্রে নানা সমস্যা করত, কিন্তু এবারের মতো তা আগে দেখা যায়নি— বলছিলেন ডা. মাইকেল জান্ডি। ‘এনএইচএনএন’র এই নিউরোলজিস্ট বলছেন, ‘১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির পরের ১০ বা ২০ বছরে আমরা দেখেছিলাম মস্তিস্কের বিভিন্ন রোগ বেড়ে গেছে। তাই এখনই এ বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত গবেষণা দরকার।’

***বিবিসির মেডিকেল করেসপন্ডেন্ট ফার্গাস ওয়ালশের ‘Coronavirus: What does Covid-19 do to the brain?’ প্রতিবেদন অবলম্বনে

আইসিইউ করোনাভাইরাস করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কোভিড-১৯ টপ নিউজ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র মস্তিষ্কের সংক্রমণ শ্বাসতন্ত্র


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর