এমপির মেয়ে বলে চাকরিটা এখনো আছে!
৪ জুলাই ২০২০ ১৬:১৯
ঢাকা: ২০০৫ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন জামালপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান দুলালের মেয়ে ফারজানা হক। বাবার উদ্যোগে চাকরির চার বছরের মাথায় নিজ উপজেলা ইসলামপুরের জগৎ জ্যোতি ক্ষেত্র মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন তিনি। কিছুদিন চাকরি করার পর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে একমাসের ছুটি নেন। সেই একমাসের ছুটি শেষ হয়নি ১১ বছরেও। বছরের পর বছর বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলেও চাকরি যায়নি তার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বাবা সংসদ সদস্য হওয়ায় শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারাও এমপির মেয়ের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেননি। ফলে এমপি-কন্যা এতদিন বেতন তোলেননি, চাকরি থেকেও ইস্তফা দেননি।
সম্প্রতি বিষয়টি নতুনভাবে আলোচনায় আসায় জেলা শিক্ষা প্রশাসন থেকে বিষয়টির তদন্ত শুরু হয়। ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় শিক্ষিকা ফারজানা হকের বিষয় সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. আশরাফুর রহমান এ বিষয়ে খুব বেশি কথা বলতে চাননি। ফোন করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ওই শিক্ষক দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে হয়তো বিষয়টির সুরাহা হবে। আমি এর বেশি কিছু আপাতত বলতে পারছি না।’
ওই শিক্ষিকার বিষয়ে প্রথমে কথা বলার চেষ্টা করা হয় ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল গফুর খানের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং মোবাইল ফোনে কথা বলা সম্ভব নয় বলে জানান।
পরে আবার তাকে ফোন করে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হলে বলেন, ‘আমি দু’মাস হলো এই ক্লাস্টারের দায়িত্ব পেয়েছি। আগে থেকে বিষয়টি আমরা জানতাম না। পরে অভিযোগ আসায় তদন্ত শুরু করি। ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় আমরা আমাদের লিখিত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে আরেক সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ওই ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নই। তারপরও বিষয়টি জানি।’
খুরশীদ আলম চৌধুরী বলেন, ‘উনি (ফারজানা হক) অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন বলে শুনতে পেরেছি। ভালো অবস্থানে সেখানে আছেন। সুতরাং তিনি চাইলে এতদিন এই চাকরিটা না করলেও পারতেন।’
এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, ‘ওই শিক্ষক বহুদিন ধরে অনুপস্থিত। আমরা সেই বিষয়টি জেলা শিক্ষা অফিসারকে জানিয়েছি।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই শিক্ষক অনুপস্থিত শুধু এক লাইনের এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি এই প্রক্রিয়াটি সঠিক নয়। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তাকে শোকজ লেটার দিতে হয়। পরপর তিন বার শোকজ দিতে হয়। কিন্তু তার বেলায় এসব প্রক্রিয়ার কিছুই অনুসরণ করা হয়নি। এ সব করার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল উপজেলা শিক্ষা অফিসের।’
‘আমরা ৩০ তারিখে প্রতিবেদন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে পাঠিয়েছি। এখন অধিদফতর থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটির অপেক্ষায় আছি। অধিদফতর থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া আমরা তা মেনে চলব,’— বলেন জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুর রাজ্জাক।
নিজের মেয়ের চাকরির বিষয়ে জানতে চাইলে জামালপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান দুলাল দাবি করেন, তার মেয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত এটি সত্য। মেয়ের স্বামী অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। তাই তার মেয়ে সেখানে সেটেল হয়েছেন। তার মেয়ে চাকরিতে থাকলেও কোনো বেতন তোলেননি। কোনো সরকারি চাকরিজীবী কর্মস্থলে পাঁচ বছর না থাকলে তার চাকরি থাকে না। বিধি অনুযায়ী তার মেয়ের চাকরি থাকার কথা না। সুতরাং এটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন ওই সংসদ সদস্য।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর তার স্বামী তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চেয়েছে। আমি তো তাদের সিদ্ধান্তে বাধা দিতে পারি না। মেয়ের চাকরি এখনও আছে। শিক্ষা বিভাগের লোকজনকে বলেছি দরকার হলে আমার মেয়ে রিজাইন দেবে।’
বিষয়টি নিয়ে তার বিরোধীপক্ষ হইচই শুরু করেছে বলে দাবি করেন সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান। তিনি বলেন, ‘আমি তিন বারের এমপি। তারা আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। আমার বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের মধ্যে আছেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যের ছেলে মীর শরিফ হাসান লেলিন। আমি তারপরও কিছু বলছি না। ধৈর্য্য ধরে আছি। আমার বাবাও ধৈর্য্যশীল ছিলেন। ধৈর্য্যের এই শিক্ষাটি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি।’
এমপি ফরিদুল হক বলেন, ‘বিদেশ থেকে আমার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। মেয়ে কান্নাকাটি করছে আর বলছে, বাবার মাথা কাটা গেল। সত্যি সত্যি আমি লজ্জা পাচ্ছি। আমি চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে পারতাম। কিন্তু আমি সে পথে যাইনি। ধৈর্য্য ধরে আছি।’
এ সময় এমপি আরও বলেন, ‘আমার মেয়ে বিদেশ যাওয়ার কয়েকদিন পরেই চাকরি থেকে রিজাইন দিয়েছিল। কিন্তু সেই রিজাইন লেটারের ফাইল মিসিং হয়েছে। এর সঙ্গে শিক্ষা অফিসের লোকজন জড়িত থাকতে পারে। আমরা স্বচ্ছ আছি বলেই তো আমার মেয়ে কোনো বেতন তোলেনি। সরকারি টাকা অন্যায্যভাবে নিতে চাইনি। প্রয়োজনে আমার মেয়ে আবার রিজাইন লেটার দেবে।’