‘ব্যবসা করতে না পারলে রোগীদের চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ব’
৪ জুলাই ২০২০ ১৮:২৬
ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ওয়ারী এলাকায় চলছে পূর্বঘোষিত লকডাউন। শনিবার (৪ জুলাই) ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে এ লকডাউন শুরু হয়েছে; চলবে ২৫ জুলাই পর্যন্ত। এ সময় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাইরে যেতে না দেওয়ার বিষয়ে অনড় থাকার কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে লকডাউন শুরুর পর থেকে প্রথম দুঘণ্টা বাইরে বের হওয়ার জন্য গেইটে কাউকে না পাওয়া গেলেও সকাল নয়টার পর থেকে ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। যারা বাইরে যাওয়ার জন্য গেইটে ভিড় করেন তাদের বেশির ভাগেরই বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা ও দোকান রয়েছে। ঈদ বাজারের দোহাই দিয়ে তারা বাইরে যেতে চাচ্ছেন। আর এই ভিড় নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের। তবে রোগী ছাড়া এখন পর্যন্ত অন্য কাউকে বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওয়ারীর টিপু সুলতান রোড, যোগীনগর রোড ও জয়কালী মন্দির, বলধা গার্ডেন, লারমিনি স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, র্যাংকিং স্ট্রিট ও নবাব স্ট্রিট এলাকার বাহির-প্রবেশের মোট ১৭টি গেইট বা সড়ক মুখ রয়েছে। তবে এসব সড়কের ১৫টির মুখ বন্ধ করে মাত্র টিপু সুলতান রোড এবং হট কেক গলি নামের ২টি পথ খোলা রাখা হয়েছে। আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি পথেই ওয়ারীর বাসিন্দারা বাইরে যাওয়ার জন্য ভিড় করছেন। তবে কাউকেই যেতে দেওয়া হয়নি। অনেককে দীর্ঘক্ষণ তর্ক করতেও দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ মেডিকেলের অযুহাতে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও অনুমতি মেলেনি।
বেলা ১১টার দিকে হট কেক গলির প্রবেশ মুখে স্বপন মাহমুদ নামের এক বাসিন্দাকে দেখা যায় বাইরে যাওয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে অনেক্ষণ তর্ক করতে। শেষ পর্যন্ত তাকে গেটের বাইরে যেতে দেয়নি পুলিশ। সারাবাংলাকে স্বপন মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশ শুধুমাত্র মেডিকেলের রোগীদের বাহিরে যেতে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা ব্যবসা করতে না পারলে রোগীদের চেয়ে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ব।’
খলিলুর রহমান নামে ওয়ারীর আরেক বাসিন্দাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বের হলেও গেইট থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খলিলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা আছে। সামনে ঈদ। নানা প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে এখন। কিন্তু ঈদের আগে যদি এভাবে ঘরবন্দি হয়ে থাকি, তাহলে ব্যবসা করব কীভাবে? আর সারাবছর সংসার চালাব কীভাবে?
তিনি আরও বলেন, ‘রোজার ঈদেও ব্যবসা করতে পারিনি। এখনও যদি না পারি তবে সব লাটে উঠবে। এটা বুঝাব কাকে? কেউ তো বুঝতে চাই না আমাদের সমস্যা। আমরা তো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ব্যবসা করতে চাইছি। সে অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। তাহলে লকডাউনের নামে এটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
এমন অভিযোগ শুধু খলিলুর রহমানের নয়, গেইটে ভিড় করা আরও একাধিক বাসিন্দার। তাদের সবার অভিযোগ বাহিরে যাওয়া জরুরি হলেও বাহিরে যেতে দিচ্ছে না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বরত ওয়ারী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জহির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপনি তো দেখলেন বাহিরে যেতে দিচ্ছি না বলে আমাদের ওপর রাগ দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা তো তাদের জীবনের কথা ভেবেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সকাল থেকে এমন একাধিক বাসিন্দাকে বুঝিয়ে শত চেষ্টায় বাসায় পাঠিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘তাদের আমরা বোঝাতে চাচ্ছি, ব্যবসার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু উল্টো তারা আমাদেরকে বুঝাচ্ছে, ব্যবসা না থাকলে জীবনের কী হবে। তাহলে বুঝেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কষ্টকর। তবুও আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। এখন পর্যন্ত পুলিশ, চিকিৎসক-নার্স এবং সাংবাদিক ছাড়া কাউকে ভেতরে এবং বাহিরে যেতে দেওয়া হয়নি।’
এদিকে লকডাউনে যেকোনো ধরণের অনিয়ম রোধে পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনের পাশাপাশি ওয়ারী এলাকায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। এতে লকডাউন কার্যকরে স্থানীয় প্রশাসন অনেকটাই আশাবাদী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাকালে রাজধানীতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত টহল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে আমাদের সদস্যরা ওয়ারীতেও টহল দিচ্ছেন।’
তবে প্রথম দিন স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে তেমন কোনো ব্যস্ততা দেখা যায়নি। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক রফিকুল ইসলাম রঞ্জু সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম দিন তো তাই বাসিন্দাদের এখনও তেমন কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না। বলতে গেলে এখন পর্যন্ত কারও কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখিনি। অনেকে লকডাউনের খবর পেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী আগে থেকেই সংগ্রহ করে রেখেছেন। তবুও আমরা প্রস্তুত আছি। যদি হঠাৎ কারও কোনো প্রয়োজন পড়ে, সেজন্য।’
লকডাউনের বিষয়ে ডিএসসিসির ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সারওয়ার হোসেন আলো সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য প্রায় দুইশ’ স্বেচ্ছাসেবী নিয়োজিত রেখেছি। যাতে করে কোনো বাসিন্দার যেন নিত্য প্রয়োজনে বাইরে যেতে না হয়। পাশাপাশি লকডাউন এলাকার ভেতরে সবগুলো সুপারশপ খোলা রাখা হয়েছে। এতে নিত্য প্রয়োজনী পণ্যের জন্য এলাকার বাইরে যেতে হবে না, সুপারশপগুলোতেই মোটামুটি সব পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, তারপর কেউ কেউ ব্যবসার অযুহাত দেখিয়ে বাইরে যেতে চাচ্ছে। আবার কেউ কেউ হাসপাতালের অযুহাত দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন বলি, জীবনের চেয়ে ব্যবসা বেশি গুরুত্বপূর্ণ না, তখন অনেকে বুঝে বাসায় ফিরে যাচ্ছে; আবার অনেকেই তর্ক করছে। অনেকেই হাসপাতালে যাওয়ার অযুহাত দেখাচ্ছে। তাদের যখন বলি, অ্যাম্বুল্যান্সে ওঠো, আমাদের কর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে যাবে এবং চিকিৎসা শেষে নিয়ে আসবে। তখনই তারা পিছু হাটে। এতে বুঝায় যায় তারা অযুহাত দেখাচ্ছে। তবে আমরা এতে কোনো সুযোগ দিচ্ছি না। কঠোরভাবে লকডাউন বাস্তবায়নে যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সবই নিচ্ছি।’
কাউন্সিলর আলো বলেন, ‘নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের জন্য আমরা খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেছি। নমুনা সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপন করেছি। টেলিমেডিসিন সেবা ও অ্যাম্বুলেন্স এবং আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত রেখেছি। সব মিলিয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন বাসিন্দাদের সহযোগিতা। তবেই আমরা সফল হব।’