ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ট্যুরিজম খাত, প্রণোদনা কাগজে-কলমেই
৫ জুলাই ২০২০ ০০:২৬
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য খাতের মতো ট্যুরিজম খাতও ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। বলতে গেলে অন্য খাতের চেয়ে একটু বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত এই খাতটি। এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তিন লাখ মানুষ এবং পরোক্ষাভাবে নির্ভরশীল ৪০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে ট্যুরিজম খাত। তার ওপর সরকার ঘোষিত প্রণোদনা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
শনিবার (৪ জুলাই) সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা জাভেদ আহমেদ, প্যাসিফিক ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র মহাসচিব তৈফিক রহমান, ট্রাভেলস রাইটারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমকে জিলানী।
জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পর্যটন খাত সম্পর্কে সেরকম ধারণা অনেকের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এই খাতটা ক্রমে ক্রমে অনেক বড় হচ্ছে। আপনারা শুনলে অবাক হবেন, প্রায় দেড় কোটি ডমেস্টিক ট্যুরিস্ট আমাদের রয়েছে। আমরা এক বছরে প্রায় দেড় কোটি মানুষকে হ্যান্ডেল করি। অর্থাৎ দেড় কোটি মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বেড়াতে যায়। প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেশের বাইরে যায় পর্যটনে। এক থেকে দেড় লাখ মানুষ ইনবাউন্ড ট্যুরিজমে আসে, অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমাদের দেশে আসে। এ সেক্টরটির সঙ্গে প্রায় তিন লাখ মানুষ ডাইরেক্ট জড়িত। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই সেক্টরটার ওপর নির্ভরশীল।’
‘সুতরাং এই সেক্টরটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানে সন্ধানে থাকা জেনারেশনের জন্য। কারণ, একজন ট্যুরিস্ট দশ ধরনের সেবা নেয়। মানে দশ ধরনের জব ক্রিয়েট করে একজন ট্যুরিস্ট। অর্থাৎ এই সেক্টরটা লেবার জেনারেট করে। আমাদের দেশে মানুষও অনেক বেশি। সুতরাং কর্মসংস্থান তৈরিতে অনন্য ভূমিকা পালন করে এই ট্যুরিজম খাত’— বলেন জাভেদ আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘ইউএনডব্লিউটিও’র ওয়েবসাইটে লেখা আছে ট্রাভেলস ইজ ডাউন, ফেয়ার ইজ আপ, ফিউচার ইজ আনসার্টেন। আমাদের অবস্থাও কিন্তু ওই একই রকম। আমাদের ট্রাভেল ইজ ডাউন, ফেয়ার ইজ আপ, ফিউচার ইজ আনসার্টেন। কিন্তু এ রকম অবস্থায় থাকলে তো চলবে না। এর মধ্য দিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। লকডাউন পিরিয়ডটাতে আমরা আমাদের অফিস বন্ধ রাখিনি। রিমোট থেকে কাজ করেছি। আমাদের লস এবং ডেমারেজ কী হয়েছে, সেটা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি। এপ্রিল পর্যন্ত আমরা হিসাব করেছিলাম পাঁচ হাজার সাতশ কোটি টাকা আমরা ক্ষতির মধ্যে পড়েছি।’
জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘ট্যুরিজমের একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। এটা একা একা চলে না। আমাদের আশপাশের দেশ ইন্ডিয়া, নেপাল, শ্রিলংকা, মালদ্বীপ— এদের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ওই সমস্ত দেশ যেভাবে ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান তৈরি করেছে, সেভাবে আমরাও আমাদের স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলে রিকভারি প্ল্যান তৈরি করেছি ইউএনডব্লিউটিও’র গাইড লাইন মেনে। এটা আমাদের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার করেছে।’
তিনি বলেন, ‘নিউ নরমাল বলে একটা কথা আছে। কারণ, প্যানডেমিক তো সারাজীবন থাকবে না। প্যানডেমিক একসময় ওভার হয়ে যাবে। তখন আমরা আবার বিজনেস শুরু করব। বিজনেসে কী কী থাকবে, কোথায় আমরা ছাড় দেবো, কোন জায়গাতে আমরা প্রণোদনা দেবো— এই সমস্ত বিষয় আমরা প্ল্যানের মধ্যে পরিষ্কার করে লিখেছি।’
জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘এই সেক্টরটা ভয়নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এই সেক্টরে অনেক বিনিয়োগ আছে, অনেক লোক কাজ করে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি যে, সরকার ঘোষিত যে প্রণোদনা, সেটা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে ট্যুরিজম খাত। কিন্তু প্রণোদনা পেতে দেড়ি হচ্ছে।’
তৈফিক রহমান বলেন, ‘প্যানডেমিকের কারণে ট্যুরিজম একেবারে চলছেই না। বছরের শুরুতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। যে সময়টাতে বন্ধ হয়েছে সে সময়টা ছিল একেবারে পিক সিজন। সেটা আমরা ডমিকস্টিক ট্যুরিজমের কথাই বলি বা ইনবাউন্ড ট্যুরিজমের কথাই বলি বা আউটবাউন্ড ট্যুরিজমের কথাই বলি। সব ক্ষেত্রেই আমাদের কার্যক্রম একেবারে থমকে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত তিন মাসে অফিসে গিয়েছি চার/পাঁচ দিন। আসলে ওখানে গিয়ে আমি কী করব? ওখানে গিয়ে তো আমার কোনো কাজ নেই। আমার স্টাফদের বলা হয়েছে তোমরা এখন আপাতত ঘরে বসেই কাজ কর। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তৌফিক রহমান বলেন, ‘ট্যুরিজম কিন্তু উচ্চ বা মধ্য শিল্প নয়, এটাকে ক্ষুদ্র শিল্পই বলা চলে। এখানে যারা বিনিয়োগ করে তাদের পক্ষে এই তিন মাস চালিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে অফিস ভাড়া আছে, ইউটিলিটি চার্জ আছে, কর্মী বেতন আছে। তাদের হাতে এমন কোনো উদ্বৃত্তও থাকে না যে উদ্বৃত্ত দিয়ে তিন মাস/চার মাস তারা চলতে পারে। সব চেয়ে অনিশ্চয়তার জায়গা হলো, সামনে তো আমরা কোনো আলো দেখতে পারছি না। কেউ আমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না যে, আগামী সেপ্টম্বর মাস থেকে সিচুয়েশন ভালো হয়ে যাবে। আগামী অক্টোবর থেকে আপনারা আপানাদের ট্যুরিজম চালাতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘এই সংকট মোকাবিলায় সারাপৃথিবীতে যেটা ঘটেছে সেটা হলো সরকার এগিয়ে এসেছে এবং সরকারকে এগিয়ে আসতেই হয়। কারণ, পর্যটন এমন একটা শিল্প যে শিল্পের সঙ্গে সরকারের অনেকগুলো অর্গান জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সেটা এখন পর্যন্ত কাগজ-কলমেই আছে। আমাদের কেউ কোনো টাকা এখন পর্যন্ত পায়নি। আমাদের বলা হয়েছে ব্যাংক এবং ক্লায়েন্টের রিলেশনের ওপর নির্ভর করবে এই প্রণোদনা।’
‘দুয়েকটা ব্যাংকের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছে, সরকার-অর্থ মন্ত্রণালয়-বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন কোনো নোটিশ আমাদের কাছে আসেনি, যার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদেরকে আমরা লোন দিতে পারি। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি আসবে না এবং সেখানে পর্যটন খাত সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা থাকবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আমদের সঙ্গে কথাই বলবে না, প্রণোদনা ঋণ তো অনেক পরের বিষয়।’
আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘ট্যুরিজম খাতের সঙ্গে আরও অন্তত দশটা খাত সম্পৃক্ত। সুতরাং ট্যুরিজম খাত বাধাগ্রস্থ হলেও ওই খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও) কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস পর্যটন খাত সারাবাংলা ফোকাস