ডলার-ইউরোর দাম বৃদ্ধি: এক প্রকল্পেই গচ্চা ৪৫৩ কোটি টাকা
৫ জুলাই ২০২০ ২০:৫৫
ঢাকা: চায়না এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ কার্যকরে দীর্ঘসূত্রিতাসহ বিভিন্ন আরও কিছু কারণে যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি ‘ইনস্টলেশন অব সিংগেল মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প। সহজে, নিরাপদে ও স্বল্প খরচে তেল খালাসের লক্ষ্যে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে ঠিক সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন উল্টো বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। বিশেষ করে এই সময়ে ডলার ও ইউরোর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই প্রকল্পটিতে খরচ হচ্ছে বাড়তি ৪৫৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
চায়না এক্সিম ব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পক্ষে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) বাস্তবায়ন করছে প্রকল্পটি। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এর দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উঠছে আগামীকাল সোমবার (৬ জুলাই)। এর সঙ্গে আরও আটটি প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে এই বৈঠকে। প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় শুরু থেকেই ধীর গতি দেখা যাচ্ছে তেল খালাসের পাইপলাইন স্থাপনের এই প্রকলপইটতে। যে কারণে তিন বছর মেয়াদে হাতে প্রকল্পটির মেয়াদ একবছর বাড়িয়েও চার বছরে ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। একই সময়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি আরও কম— মাত্র ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ।
মূল অনুমোদিত প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তায়নের লক্ষ্যে অনুমোদন পায়। পরে প্রকল্পটিতে তেমন অগ্রগতি না থাকায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হয় ৪৯০ কোটি টাকা। এ পর্যায়ে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ টাকায়। কিন্তু প্রকল্পের চার বছর মেয়াদ শেষে অগ্রগতির চিত্র হতাশাজনক হওয়ায় দ্বিতীয় সংশোধনীতে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আড়াই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এসময় এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬ হাজার ৫৬৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় বাড়ছে ২১ শতাংশ।
প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চায়না এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ কার্যকর হতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ায় সময় বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যদিকে ব্যয় বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার ও ইউরো) বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৪৫৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রেফারেনশিয়াল পলিসির আওতায় শুল্ক মওকুফ বিবেচিত না হওয়ায় সিডি ভ্যাটের জন্য ব্যয় বাড়ছে ৫৫২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। স্থাবর সম্মতি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ অনুযায়ী জমির ক্ষতিপূরণ মূল্য তিন গুণ হারে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে ব্যয় বাড়ছে ১৩৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যাংক চার্জ, রেজিস্ট্রেশন ফি, লাইসেন্স ফি বাবদ ব্যয় বাড়ছে আরও ৬৭ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মোট এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা বাড়তি ধরা হচ্ছে সংশোধনীতে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৫ মিলিয়ন টন হাই স্পিড ডিজেল (এইচএসডি) আমদানি করতে হয়। এছাড়া আন্তঃদেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় আরও বেশি পরিমাণ এইচএসডি আমাদানির প্রয়োজন পড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের নাব্য কম (৮-১৪ মিটার) হওয়ায় মাদার অয়েল ট্যাংকারগুলো সরাসরি খালাস করা সম্ভব হয় না। এ কারণে এসব ট্যাংকার গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করে ছোট ছোট লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল খালাস করা হয়। এভাবে ১১ দিনে একটি এক লাখ ডিডব্লিউটি ট্যাংকার খালাস করা যায়। গতানুগতিক এই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় এইচএসডি স্থানান্তরের জন্য পাইপলাইন বসানোর প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।
‘এসপিএম উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটি মহেশখালী দ্বীপের পাশে বঙ্গোপসাগরে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মাতারবাড়ি এলটিই পর্যন্ত এবং সেখান থেকে অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় স্থাপিত স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে এইচএসডি। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যসের দু’টি আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোডিং করা হবে। এছাড়া মহেশখালী স্টোরেজ ট্যাংক থেকে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে তেল প্রথমে আনশোর ও পরে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পাঠানো হবে। এরপর মহেশখালী স্টোরেজ ট্যাংক ফার্ম থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের মাধ্যমে দু’টি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল ইআরএলে ডেলিভারি করা হবে।
দীর্ঘসূত্রিতায় সময় ও খরচ বাড়লেও বাস্তবায়ন করা গেলে প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রতিবছর তেল খালাসে বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলেই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ার সুপারিশ করবে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামীমা নার্গিস সারাবাংলাকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে, প্রচলিত লাইটারেজ পদ্ধতিতে তেল খালাস করা সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু দেশে জ্বালানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পাইপলাইন স্থাপনের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে বাড়তি চাহিদা পূরণে আমদানি করা ক্রুড অয়েল ও ফিনিসড অয়েল সহজে, নিরাপদে, স্বল্প খরচে এবং স্বল্প সময়ে খালাস নিশ্চিত করা যাবে। এতে করে প্রতিবছর সরকারের আটশ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে। সে কারণেই দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবটি বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করছে কমিশন।
একনেক উঠছে আরও যে ৮ প্রকল্প
সোমবারের একনেকে আরও যে আট প্রকল্প উঠবে, সেগুলো হলো— ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্প, নওগাঁ জেলার ধামুইরহাট,পত্নীতলা ও মহাদেবপুর উপজেলার তিনটি প্রকল্পের পুর্নবাসন এবং আত্রাই নদীর ড্রেজিংসহ তীর সংরক্ষণ; দিনাজপুর শহর রক্ষা প্রকল্পের পুনর্বাসন এবং দিনাজপুর শহর সংলগ্ন ঢেপা ও গর্ভেশ্বরী নদী সিস্টেম ড্রেজিং ও খনন; গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাঁচপীর বাজার-চিলমারী উপজেলা সদর দফতরের সঙ্গে সংযোগকারী সড়কে তিস্তা নদীর ওপর ১৪৯০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ; রূপগঞ্জ জলসিড়ি আবাসন সংযোগকারী সড়ক উন্নয়ন; জামালপুর ও শেরপুর জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন; চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলাধীন ডাকাতিয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণ; এবং এস্টাবলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিসট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম আন্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম প্রকল্প।
ইনস্টলেশন অব সিংগেল মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড একনেক এসপিএম প্রকল্প দ্বিতীয় সংশোধনী পাইপলাইন পাইপলাইন স্থাপন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ব্যয় বৃদ্ধি সময় বৃদ্ধি হাই স্পিড ডিজেল