লকডাউন ওয়ারী: বাইরে যাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন অজুহাত বাসিন্দাদের
৬ জুলাই ২০২০ ২৩:১৫
ঢাকা: স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী করোনার ঝুঁকি থাকায় পূর্বঘোষিত লকডাউন চলছে ওয়ারীতে। এতে বাসিন্দাদের চিকিৎসা বা অতি প্রয়োজনীয়তা ছাড়া আর কোনো প্রয়োজনে বাইরে বের হতে দিচ্ছে না পুলিশ। এজন্য এলাকার ১৭টি প্রবেশমুখের ১৫টি বন্ধ করে দিয়ে জরুরি যাতায়াতের জন্য দুটি পথ খোলা রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। এ দুটি পথ দিয়ে উপযুক্ত কারণ ছাড়া বের হওয়া ও ঢোকার সুযোগ নেই। তাই নানা অজুহাতে বাসিন্দারা বাইরে যেতে চাইছে প্রতিনিয়ত।
গত ৪ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ওয়ারীতে লকডাউনের তৃতীয় দিনে বাসিন্দাদের মাঝে দেখা গেছে এমন প্রবণতা। কেউ নানা অযুহাতে খোলা থাকা গেইট দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ পুলিশের নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে বের হতে না পেরে বন্ধ থাকা গেইট টপকে বের হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাসিন্দাদের কেউ কেউ লকডাউনের কারণে অসন্তোষও প্রকাশ করছে। কেউ কেউ আবার রীতি মতো পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছে। এতে লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
সোমবার (৬ জুলাই) সরেজমিনে দেখা যায়, র্যাংকিন স্ট্রিটের গলির মুখের বন্ধ গেইট টপকে এদিন অনেকেই বাইরে যাচ্ছে ও ভেতরে ঢুকছে। তবে যারা যাওয়া-আসা করছেন তাদের দাবি, অতি প্রয়োজনে নিরুপায় হয়েই তারা এমনটা করছেন। তাদের প্রয়োজনীয়তা পুলিশ বুঝতে চায় না বলে অভিযোগ করছেন তারা।
ওয়ারীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (ছদ্মনাম) তার স্ত্রীকে নিয়েই বন্ধ গেইটের বাঁশের ফাঁক গলিয়ে বাইরে বের হয়েছেন। এভাবে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক প্রকার নিরুপায় না হলে এমনটা কেউ করে না। দেড় বছরের নাতি অসুস্থ। তাকে নেওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে যাচ্ছিলাম। খোলা গেইটে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা বের হতে দেয়নি। পুলিশ বলেছে, নাতি অসুস্থ হয়েছে বুঝলাম। কিন্তু সেতো এখানকার না। তাছাড়া সে যে অসুস্থ তার প্রমাণও তো নেই। কীভাবে বুঝবো? এখন নাতির অসুস্থতার প্রমাণ দিতে হলে তো আমাকে হাসপাতাল যেতে হবে। কিন্তু সে উপায় তো নেই। তাই নিরুপায় হয়েই এখান দিয়ে বের হলাম।’
শুধু নুরুল ইসলাম কিংবা তার স্ত্রী নয়, এমন অনেকেই প্রমাণ ছাড়া বের হতে পারছেন না; আবার অনেকেই আজগুবি সব গল্প বানিয়ে গেইট দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। যে কারণে প্রকৃত প্রয়োজনে যাদের বের হওয়া দরকার তারা বিপাকে পড়েছেন।
এবিষয়ে ওয়ারী থানার ইন্সপেক্টর রঞ্জিত কুমার সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নির্দেশ দেওয়া আছে, শুধুমাত্র হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক-নার্স এবং পুলিশ ও সাংবাদিক ছাড়া আর কাউকে যেন বাইরে যাওয়ার ও ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি না দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি আমরা। কিন্তু কখনও কখনও দেখা গেছে নিয়মের কারণে কেউ কেউ অতি প্রয়োজন হলেও প্রমাণ না থাকায় বের হতে পারছেন না। এটার জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্ত আমাদের কিছুই করার নেই।’
ইন্সপেক্টর রঞ্জিত বলেন, ‘লকডাউন শুরুর পর থেকে অনেকেই বিভিন্ন অযুহাতে বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। তার মধ্যে কমন সমস্যা দেখিয়েছে- অসুস্থ, হাসপাতালে রোগী, ওষুধ আনতে হবে। কিন্তু যখন বলা হয় হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স আছে, তখন আর সেটাতে ওঠে না। ওষুধ এনে দেওয়ার কথা বললে তখন চলে যায়। আর রোগী দেখতে যাবে এমনটা বলার পর কোন হাসপাতালে রোগী, কত নম্বর ওয়ার্ডে এ সবের তথ্য চাইলে কেউ দিতে চায় না। আবার অনেকেই মিথ্যা বলে ধরা পড়ে। যে কারণে এখন আমরা এসব কমন সমস্যায় প্রমাণ ছাড়া কাউকে যেতে দিচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘আবার এমনও হতে পারে তিনি সত্যি বলেছেন। কিন্তু আমরা তো অযুহাতের শিকার হয়ে সত্যটাও বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ প্রমাণ নেই। তাই এসবের কারণে প্রকৃতার্থে যারা সেবা পেতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি উত্তম সেবা দেওয়ার জন্য।’
বন্ধ থাকা গেইট টপকে বের হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বন্ধ থাকা গেইটগুলোতে স্ট্যান্ডবাই আমাদের কেউ ডিউটি করে না। খোলা দুটি গেইটে আমাদের সার্বক্ষণিক ডিউটি। তবে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি আমরা। কিন্তু আসল কথা হলো- লকডাউনের সুফলটা যদি বাসিন্দারা না বুঝে, বেঁধে রেখেও কাউকে বুঝানো যাবে।’
এদিকে লকডাউন নিয়ে বাসিন্দাদের কেউ কেউ অসন্তোষও প্রকাশ করছে। যে কারণে পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে বাইরে বের হওয়া নিয়ে প্রতিদিনই তর্কে জড়াচ্ছেন বাসিন্দাদের কেউ কেউ। এমন অভিযোগ স্বেচ্ছাসেবীদের। স্বেচ্ছাসেবক নিয়াজ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছায় ঝুঁকি নিয়ে বাসিন্দাদের সেবা দিতে দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু বাসিন্দারা উল্টো আমাদের বকছে। তাদের কথা, সারাদেশের কোথাও লকডাউন নেই, শুধু এই এলাকায় লকডাউন দিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষতি করছে।’
ওয়ারী থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রবিউল ইসলামও একই কথা বললেন। তিনি বলেন, ‘এলাকার ব্যবসায়ীরাই বেশি ঝামেলা করছে। তারা বলছে, আমরা নাকি তাদের ব্যবসার ক্ষতি করছি। এজন্য আমাদের সঙ্গে রাগারাগি করে। এখানে আমাদের দোষ কোথায়। যদিও আমরা চেষ্টা করি তাদের বুঝিয়ে বাসায় ফেরত পাঠাতে।’
লকডাউনের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ারীর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত নানান অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি। তবে লকডাউন সফল করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। এজন্য আমাদের সদস্যদের নির্দেশনা হয়েছে, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে যেন দায়িত্ব পালন করে। তারা যেন কোনো বাসিন্দার সঙ্গে খারাপ আচরণ না করে। আমরা চাই মানবিক মূল্যবোধে বাসিন্দাদের জাগ্রত করতে। তাহলেই লকডাউন কার্যকর সম্ভব হবে।’