চিকিৎসক নিয়োগ: উত্তীর্ণদের রেখে নতুন বিসিএস চায় মন্ত্রণালয়
৯ জুলাই ২০২০ ২২:৪৪
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংকট মোকাবিলায় আরও দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৩৯তম বিসিএসের প্রার্থীরা বলছেন, তাদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দেওয়া হোক নতুন চিকিৎসকদের। নিয়োগ পেতে চান সদ্যোত্তীর্ণ ৩৮তম বিসিএসের প্রার্থীরাও। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করে নিয়োগ দেওয়া হবে। দুই দুইটি বিসিএসের প্রার্থী থাকতেও নতুন বিসিএস আয়োজনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে নতুন বিসিএস আয়োজন নিয়ে চিন্তায় পড়েছে সরকারি কর্ম কমিশনও (পিএসসি)।
জানা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিলে ৩৯তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আর ২০১৯ সালের এপ্রিলে তার ফল প্রকাশ করা হয়। ৩৯তম ব্যাচে উত্তীর্ণদের ভেতর থেকে ৪ হাজার ৭৯২ জন চিকিৎসককে নিয়োগের সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন। ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে ৪ হাজার ৪৪৩ জনকে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই বিসিএসে উত্তীর্ণ ৮ হাজার ৩৬০ জনকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য রাখা হয়। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সেই ৮ হাজার ৩৬০ জনের মধ্য থেকেই গত মে মাসে ২ হাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নন-ক্যাডারের তালিকায় আরও ৬ হাজার ৩৬০ জন চিকিৎসক আছেন অপেক্ষায়।
প্রশ্ন উঠেছে, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার চিকিৎসক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকলেও নতুন করে বিসিএস কেন আয়োজন করতে হবে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের জন্য? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ করে যখন করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে, তখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিসিএস পরীক্ষাই বা আয়োজন করা হবে কিভাবে? শুধু তাই নয়, একটি বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। টেকনিক্যাল ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস বিবেচনায় নিয়েও সে সময় খুব একটা কম নয়। এর আগে লিখিত পরীক্ষা বাদ দিয়েও কেবল প্রিলিমিনারি ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়েই চিকিৎসকদের জন্য ৩৯তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছিল দেড় বছর। যখন চিকিৎসকদের প্রয়োজনটা জরুরি, তখন কেন এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যেতে হচ্ছে মন্ত্রণালয়কে?— এসব প্রশ্ন তুলছেন উত্তীর্ণ চিকিৎসকরা।
৩৯তম বিসিএসের একাধিক প্রার্থী সারাবাংলাকে বলেছেন, কেবল চিকিৎসকদের জন্যই ৩৯তম বিশেষ বিসিএস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বিসিএসে উত্তীর্ণদের মধ্য থেকেই মে মাসে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয় সরকার। আরও প্রায় সাড়ে ছয় হাজার চিকিৎসক কিন্তু ওই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি। আমাদের বলা হয়েছিল, পদ না থাকায় নিয়োগ দেওয়া যায়নি। সুযোগ হলে নিয়োগ দেওয়া হবে। এখন সুযোগ এলেও কেন তাহলে নতুন বিসিএস পরীক্ষার কথা বলছে মন্ত্রণালয়?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, এ সিদ্ধান্ত আমি যোগদান করার আগেই নেওয়া হয়েছে। আর সে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো মতামতের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। তবে আমি মনে করি, বার বার যদি এক ব্যাচ থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়ে যাবে। নতুন মেধাবী ছেলেরা পাস করে বসে আছে। তাদেরও তো সুযোগ দিতে হবে।
এদিকে, ক’দিন হলো ৩৮তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা চিকিৎসকরাও নিয়োগ পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ৩৯তম বিসিএসের তুলনায় ৩৮তম বিসিএসের প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষাসহ দীর্ঘ যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। এখন তারা জ্যেষ্ঠ। তাই নতুন দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এ বিষয়ে তারা সরকারি কর্ম কমিশনে চিঠি লিখেছেন বলেও জানিয়েছেন। একই তালিকায় যুক্ত হতে চান ৩৯তম বিসিএসের নন-ক্যাডারে থাকা ডেন্টাল সার্জনরাও।
তবে ৩৮ ও ৩৯— দুই ব্যাচের বিসিএসে উত্তীর্ণরাই বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাতে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি, আবেদন, পরীক্ষাসহ আনুষাঙ্গিক বিষয় পেরিয়ে চূড়ান্ত করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। তাছাড়া এই করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে এখনো সব ধরনের জনসমাগম এড়াতে বলা হচ্ছে, সেখানে প্রায় ৫০ হাজার প্রার্থীর পরীক্ষা একসঙ্গে কীভাবে নেওয়া হবে— সে প্রশ্নও তোলেন তারা।
পরীক্ষার্থীদের এমন প্রশ্ন ও উদ্বেগকেও বড় করে দেখছেন না স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান। তিনি বলেন, আগেও কম সময়ে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা নেবে পিএসসি। তারা চাইলে দূরত্ব বজায় রেখে ১৫টি বোর্ড গঠন করতে পারে। এগুলো আসলে তারা ঠিক করবে।
এদিকে, নতুন বিসিএস আয়োজন করে সেখান থেকে ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদা জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে নিয়োগের অনুমতি নেওয়ার জন্য। ফিরতি চিঠি এলে সরকারি কর্ম কমিশনে পাঠানো হবে। অনুমতি মিললে পিএসসি ১৫ দিনের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করবে। সব প্রক্রিয়া শেষ করতে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগবে।
আগের বিসিএসগুলোতে উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে নিয়োগ না দেওয়ার পক্ষে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীও। তিনি বলেন, ৩৯তম ব্যাচ থেকে আমরা এ পর্যন্ত সাত হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি। এখন নতুনদেরও তো সুযোগ দিতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে নতুন বিসিএস আয়োজনের প্রস্তাব থাকলেও সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারি কর্ম কমিশনের। করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী ডেকে জনসমাগম এড়িয়ে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সংস্থাটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিএসসি’র এক কর্মকর্তা বলেন, বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যেহেতু আমাদের একটি ব্যাচ প্রস্তুত আছে, সেখান থেকে মে মাসে ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন নতুন করে এত কম সময়ের মধ্যে কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
দেশে মার্চে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ এপ্রিল ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির পর তাদেরকে গত ১৩ মে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দিন দিন এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকলে সংকট মোকাবিলায় নতুন করে আরও দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ নেয় সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে যারা নিয়োগ পাবেন, তাদের বিশেষত করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্যই নিয়োগ দেওয়া হবে। করোনা সংকট কেটে গেলে তাদের নতুন করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।
২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ ৩৮তম বিসিএস ৩৯তম বিসিএস করোনাভাইরাস চিকিৎসক নিয়োগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্ম কমিশন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়