Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুকুর পুনঃখনন প্রকল্পে ‘পুকুর সমান’ অসামঞ্জস্যতা


১০ জুলাই ২০২০ ০৮:৫০

ঢাকা: পুকুর খনন করে সমবায়ভিত্তিক পাট পঁচানো ও পরবর্তী সময়ে মাছ চাষের জন্য হাতে নেওয়া হয়েছিল ‘হাজামজা/পতিত পুকুর পুনঃখননের মাধ্যমে সংগঠিত জনগোষ্ঠীর পাট পঁচানো পরবর্তী মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন’ প্রকল্পটি। কিন্তু মূল কাজ পুকুর পুনঃখনন বাস্তবায়নে সেরকম কোনো অগ্রগতি চোখে না পড়লেও কর্মকর্তাদের আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের চিত্র উঠে এসেছে। আর সেখানেও রয়েছে ‘পুকুর সমান’ অসামঞ্জস্যতা। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল সেটি পূরণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পের আওতায় ২৮টি উপজেলার প্রতিটিতে ১০টি করে সমবায় সমিতি গঠনের কথা ছিল। আর সেখানে মাছ চাষের জন্য ১০ জন ও অন্যান্য আয় বর্ধক কাজের জন্য সমান সংখ্যক সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা কথা। কিন্তু সেখানে ২৮১টি সমিতি গঠন করে ৫ হাজার ৯২২ জন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও মানা হয়নি প্রকল্প প্রস্তাব। আবার পুকুর খননে সোয়া এক কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও একই সময়ে অগভীর নলকূপ, যন্ত্রপাতি ও পাইপলাইন স্থাপনের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ২৮০টি শ্যালো মেশিন কেনার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি শূন্য। কিন্তু প্রকল্পের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ একটি জিপ ও ২৮টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে। এর বাইরে প্রকল্পের পাঁচটি ওয়ার্কশপের মধ্যে তিনটি সম্পন্ন হলেও এ পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এগুলো ছাড়াও পুকুর পুনঃখননের ক্ষেত্রে ডিপিপির কাজের সঙ্গে দরপত্রের কাজে অনেক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের নিবিড় সমীক্ষায় উঠে এসছে এসব তথ্য। জরিপে বলা হয়েছে- প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে পতিত পুকুর পুনঃখনন করে একই পুকুরে পাট পঁচানো এবং পরবর্তীতে মাছ চাষ করা। কিন্তু পুকুরভিত্তিক মূল কার্যক্রমই বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- এখন পর্যন্ত ২৮১টি সমিতি গঠন করে ৫ হাজার ৯২২ জন সদস্যকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, যা প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী ২৮টি উপজেলায় প্রতিটিতে ১০টি করে মোট ২৮০টি পুকুর কেন্দ্রীক সমিতি গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে। যেখানে প্রতিটি সমিতিতে মাছ চাষের জন্য ১০ জন ও অন্যান্য আয় বর্ধক কাজের জন্য ১০ জন সদস্য থাকবে। কিন্তু বাস্তবে পুকুরভিত্তিক কোনো সমিতি গঠন করা হয়নি। এমনকি মাছ চাষ ও অন্যান্য আয়বর্ধক কাজের জন্য সদস্য অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ডিপিপিতে বর্ণিত আনুপাতিক হার অনুসরণ করা হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৯৮টি হাজামজা বা পতিত পুকুর পুনঃখনন ও মেরামতের জন্য মোট ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। অপরদিকে পতিত পুকুরে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাত কোটি টাকা ব্যয়ে অগভীর নলকূপ, যন্ত্রপাতি ও পাইপলাইন স্থাপনের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতিই হয়নি। তবে প্রকল্পের আওতায় ঋণ গ্রহণকারী সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৪ হাজার ৫৭৪ জন। এই অঙ্গে অগ্রগতি হয়েছে ৮১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৫০ জন উপকারভোগীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা লক্ষ্য মাত্রার ৫৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রকল্পের নির্ধারিত পাঁচটি ওয়ার্কশপের মধ্যে তিনটি সম্পন্ন হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত কোন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ উপকারভোগী পাট পঁচানোর জন্য পুকুর ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সমবায়ভিত্তিক পাট পঁচানো ও পরবর্তীতে মাছ চাষ করা হয় না। প্রকৃত পক্ষে ব্যক্তি মালিকানার পুকুরগুলো কি শর্তে সমবায় সমিতির অন্তর্ভুক্ত হবে এবং সমিতির সদস্যদের শেয়ার কি হবে এসব বিষয় তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এছাড়া কোরো পুকুরেই এখন পর্যন্ত একইসঙ্গে পাট পঁচানো এবং মাছ চাষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যবহত হচ্ছে।

সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ পাটচাষী প্রচলিত সনাতন পদ্ধতিতে পাট পঁচিয়ে থাকেন। ফলে প্রকল্পের দ্বিতীয় ও তৃতীয় উদ্দেশ্যও পূরণ হয়নি। প্রকল্পের আওতায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৮০টি শ্যালো মেশিন কেনার সংস্থান থাকলেও এখন পর্যন্ত একটিও কেনা হয়নি। তবে একটি জিপ গাড়ি ও ২৮টি মোটরসাইকেল কেনার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পুকুর পুনঃখননের ক্ষেত্রে ডিপিপির কাজের সঙ্গে দরপত্রের কাজে আরও অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।

সূত্র জানায়, পাটের আঁশ ও পানির গুনগতমান ঠিক রাখার লক্ষ্যে শ্রম ও ব্যয় সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির ব্যহারের জন্য এ প্রকল্পটি হাতে নেয় পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। এর প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে- হাজামজা/পতিত পুকুর পুনঃখননের মাধ্যমে সংগঠিত জনগোষ্ঠীর পাট পঁচানো পরবর্তী মাছ চাষ করা। এছাড়া অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে- স্বল্প খরচে লাগসই এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎকৃষ্টমানের পাটের আঁশ উৎপাদন; বাজার ব্যবস্থায় অবাধ অংশগ্রহণ এবং উৎপাদিত উৎকৃষ্ট মানের পাটের বিপণন সহজীকরণ; উন্নত মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি; সংগঠিত জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং সংগঠিত জনগোষ্ঠীর পুঁজি গঠন ও ঋণ বিতরণের মাধ্যমে আর্থিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকরী সংস্থা পিডিবিএফের তহবিল থেকে ব্যয় হবে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির অনুকূলে ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা; অর্থাৎ প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। কিন্তু এই সময় পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্য ছিল ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ। ফলে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এদিকে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতির লক্ষ্য ছিল ৮৫ শতাংশ। কিন্তু অর্জিত হয়েছে মাত্র ৪৯ শতাংশ। এক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছে ৩৬ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডি’র সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশসহ সেটি পাঠিয়ে দেওয়া হবে; যাতে তারা ক্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করতে পারে। সেইসঙ্গে আগামীতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এরকম ভুল যাতে তারা পরিহার করতে পারে।’

পুকুর খনন পুকুর খনন প্রকল্প সমবায় সমিতি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর