রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রাখার পক্ষে নারী সংসদ সদস্যরা
১১ জুলাই ২০২০ ১১:১৪
ঢাকা: নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রাখার বিধান তুলে দিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির এমন প্রাথমিক প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন সরকার দলীয় সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যরা। তারা বলেন, আমাদের দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীদের সেই অবস্থান এখনো তৈরি হয়নি। তাই আমরা চাই, নারী অগ্রযাত্রায় এই ৩৩ শতাংশ কোটা বহাল থাকুক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক এবং টানা মেয়াদে সরকার দলীয় সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইসি কেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, আমি জানি না? যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের নারী নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেন, সেখানে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না আমি জানি না? এ বিষয়ে ইসি কি বলেছেন, আমি সেটাও জানি না! আমি জেনে বাকিটা মন্তব্য করতে পারব।’
সূত্র জানিয়েছে, এর আগে রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত আইন পরিবর্তন করতে হলে দলগুলোর মতামত নেওয়া হয়েছে। তবে নারী নেতৃত্ব সম্পর্কিত ধারাটি তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছুই জানানো হয়নি। যদিও নির্বাচন কমিশন সচিবের দাবি, আইন চূড়ান্ত করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (১ জুন) প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সভাপতিত্বে ইসির কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর এ সংক্রান্ত খসড়া উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া আরপিও বাংলায় অনুবাদ করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। সিইসি কে এম নূরুল হুদা নিজেই নতুন আইনের খসড়া তৈরি করে কমিশনারদের মাঝে দিয়েছেন। খসড়া প্রস্তাবটি এখন পর্যন্ত ইসির কোনো আইন কর্মকর্তাও হাতে পাননি।
এর আগে আইন করে ২০২০ সালের মধ্যে এই শর্ত পালন করার কথা বললেও সেই ধারাটিই আর থাকছে না। সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে এ ধারাটি যোগ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে যুব মহিলা লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেত্রী সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা মীরা বলেন, ‘আসলে এটা সম্পর্কে তেমন জানি না? তবে আমি বলতে চাই, আমাদের বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নারীদের কল্যাণে কাজ করছেন এবং নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করেন। আসলে ইসি কি আলোচনা করেছে জানি না? তবে এখনো আমাদের দেশে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা তুলে দেওয়ার মতো অবস্থান হয়নি। আমি চাই নারীদের এই ৩৩ শতাংশ কোটা বহাল থাকুক।’
এ বিষয়ে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয়সহ সভাপতি আদিবা আনজুম মিতা (রাজশাহী) বলেন, ‘আমরা তো কেবল শুনেছি। আমাদের সরকারের তরফ থেকে কোন…..জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়েও কিছু বলেননি। এখন ওনারা (ইসি) চাচ্ছেন। আর এমন সময়ে (করোনাভাইরাস) এটা; আমরা যে সোচ্চার হবো, সেই পরিস্থিতিটাও এখন নাই। আমাদের মেয়েদের জন্য এটা একটা বড় প্রবলেম হয়ে গেছে। তবে ওনারা (ইসি) চাচ্ছে কিন্তু এখন পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা আমাদের বলেন নাই। তিনি সব সময় চান, মেয়েরা এগিয়ে যাবে, এই যে আমরা সংরক্ষিত এমপি হয়েছি এটাও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে চলে আসছে। বঙ্গবন্ধুর সেই পথ ধরেই আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাজ করেছেন এখন সেটা পঞ্চাশ দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের জন্য বিশাল এক পাওয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদেরকে ঘর থেকে বের করা, নেতৃত্ব দেওয়া, রাজনীতির প্র্যাকটিস করা, এটা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই চেয়েছেন বলেই আমরা এগিয়ে আসতে পেরেছি।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে তৃণমূলে নারী নেতৃত্বের অগ্রযাত্রায় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বলেন, ‘আগে তো কোনো মহিলারা চিন্তাই করতে পারত না চেয়ারম্যান মেম্বার হবে, এটাও কিন্তু তিনি (শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করেছেন। এখন ওনারা (ইসি) বলছেন, আর বললেই যে হবে! সেটাও সঠিক না। আর এখন পর্যন্ত আমরা ওটার কোনো ডিসিশন পাইনি। কনফার্ম কি না আমরা সেটাও জানি না? আমরা তো চাচ্ছি, আমাদের যে ৩৩ শতাংশ কোটাটা থাকুক। কারণ মেয়েদেরকে এগিয়ে নিতে হলে আরও এটা বাড়াতে হবে।’
পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে চলার লড়াইয়ের প্রসঙ্গ তুলে আদিবা আনজুম মিতা বলেন, ‘মেয়েদের মধ্যে অনেস্টি (সততা) বেশি থাকে। সব কাজে তাদের অনেস্টি আছে। যারা সরাসরি এমপি হয়েছেন তারা কিন্তু সততার সঙ্গে কাজ করছেন। তারপরও দেখা যায় পুরুষরা সব সময় চায়, মহিলারা বাদ থাক, মহিলারা খালি ঘরের কাজে আবদ্ধ থাকবে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেয়েদেরকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। আমি তো মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো আর একজন আছে কি না? তিনি একজন মহিলা হিসেবে যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন, যেভাবে কথা বলেন, যেভাবে ওনার স্মরণশক্তি এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন, মনে হয় যেন একজন সায়েন্টিফিক। ওনি কিন্তু একজন নারী। ওনি যদি পারেন, ওনি তো পারছেন। ছেলেদের সাথে টেক্কা দিয়ে আজকে এই জায়গায় এসেছেন। মহিলাদের যেখানেই দেওয়া হবে সেখানেই তারা ফিট। আমি মনে করি ছেলেদের সাথে কম্পিটিশনে আসতে গেলে নারীদের ৩৩ শতাংশ কোটাটা অবশ্যই রাখতে হবে।’
সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য ও নারী নেত্রী খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন বলেন, ‘এখন তো সময়ের সাথে অনেক কিছুর গতিশীলতা এসেছে। আর আমাদের দেশের নারীরা এখন অনেক সচেতন। রাজনৈতিকভাবে সামাজিকভাবে নারীরা এখন পশ্চাৎপদ নেই। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন। তাই আমি মনে করি ৩৩ শতাংশ কোটাটাই সঠিক। আমি কোটা রাখার পক্ষেই বলবো।‘
এ বিষয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্যদের। তারাও ৩৩ শতাংশ নারী কোটা বহাল রাখার পক্ষে জোরালো মতামত তুলে ধরেন।
ইসি সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোতে নারী নেতৃত্বের সর্বোচ্চ হার ছিল ১০ শতাংশ। ওই সময় আইন করা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারী নেতৃত্বের হার ৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু গত ১২ বছরেরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। এখনো বেশিরভাগ দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের উপস্থিতি ১০ শতাংশের নিচে। এ অবস্থায় এ বছরের মধ্যে ৩৩ শতাংশে নারী নেতৃত্ব উন্নীত করার আইনটি প্রতিপালন করা একরকম অসম্ভব।
এদিকে, আইনটি প্রতিপালন না হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের নিবন্ধনই বাতিল করতে হবে। এ পরিস্থিতিতেই রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘বাঁচাতে’ ইসি আইনটি পরিবর্তন করতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ তাদের সবশেষ সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে কমিটির সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার শর্ত শিথিল করেছে। আইনটি পরিবর্তনে এ সিদ্ধান্তও ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে ইসি সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনা করার মাধ্যমে নতুন আইনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন শর্তাবলী সংযোজন বা বিয়োজন করা হবে। আগামীতে পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।’
তিনি বলেন, ‘সরাসরি বা চিঠি দিয়ে কিংবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে। কিভাবে সংলাপ হবে, তা নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর।’