‘মা-ই তো মানুষের একমাত্র বাতিঘর’
৭ মার্চ ২০১৮ ১৬:৫৯
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: ‘আর একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। আর একটি দিন প্রবেশ কোরবে রাতে। গভীর অন্ধকার থেকে প্রতিদিন আলোকিত সকাল দেখায় আমাদের সকলের মা। সবার মতো জগতের মা’রাও কেন এ জগত ছেড়ে চলে যায় একদিন ‘ …..লিখেছেন কারু তিতাস। কারু তিতাস মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ছেলে।
মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মারা যান গতকাল ৬ মার্চ। রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার এই মহিয়সী নারী। যিনি প্রচলিত অচলায়তন ভেঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে প্রকাশ্যে এনেছিলেন। তিনি তখন ভাবেননি নিজের এবং পরিবারের সামজিক মর্যাদার কথাও। তিনি বলেছিলেন, ‘বীরঙ্গানা শব্দটি লজ্জার নয়,গর্বের।’
যার ফলে তিনি কেবল তার সন্তানদের মা হয়েই থাকেননি, মা হয়ে হয়ে উঠেছিলেন তরুণ প্রজন্মের।
আজ বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মাকে নিয়ে তিতাস এই স্ট্যাটাস দেন দুপুর পৌনে চারটার দিকে। দীর্ঘ স্ট্যাটাসে তিতাস আরও লেখেন, ‘সৃষ্টি কর্তা বিধাতা নাকি কোন মানুষের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ পৃথিবী থেকে তুলে নেন না।একদিন সকলের কাজ শেষ হতে পারে, কিন্তু জগতে মায়েদের কাজ কি কখনো শেষ হয়? এতো যন্ত্রনা এতো কষ্ট, এতো দূঃখ এতো বেদনা জগতে মা ছাড়া আর কে ধারণ করবে ? কে সহ্য কোরবে ? কে বহন কোরবে ? এমন যুদ্ধ এমন সংগ্রাম আর কে করে মা ছাড়া? কারো মা না থাকলে তার বাগানে সকালে কি ফুল ফোটে ? কোন পাখী আসে ? মা ছাড়া কে আলোকিত করবে এ জগতকে ? পৃথিবীতে মা’ই তো মানুষের একমাত্র বাতিঘর।’
তিতাসের দীর্ঘ স্ট্যটাসের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি লাইনে রয়েছে মাকে নিয়ে অনুভুতি, মাকে হারানোর অনুভুতি। আর সে প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি লাইনে রয়েছে মায়ের প্রতি আকুলতা। তিতাস লেখেন, ‘এ জগত ছেড়ে যেতে আজ আমার কোন দূঃখ বা কোন মায়া নেই । আমার তেমন কিছু জগতকে দেবারো নেই নেবারো নেই। কিন্তু মায়েদের তো আজো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে , জগত তাঁদের পানে চেয়ে থাকে যে ! তাঁদের যে অনেককিছু দেবার থাকে আজীবন। এই জগত মা ছাড়া আর কার কাছে কি চাইবে ? জীবনের সব দাবীই তো ঐ মায়ের কাছে। জগতেের সকল সুখ যে মা’য়ের পায়ে । মা তো হিমালয়, আছেও থাকবেও।
আজকাল মার সাথে ছবি তুললেই মা বলে, ‘ এটাই বোধহয় আমার শেষ ছবি ‘!!! কেন বলে ?!!! আমার কেমন যেন ঘোর লেগে যায় ! মা আমার বোকা, ছোটবেলার মতো ভয় দেয়। মা আমার কি সত্যিই বোকা ?
মায়েরা জগত সংসারের বহুদূর দেখতে পায়। আমি কেন পাই না ?!!!’
গতকাল রাতে মারা যাবার পর প্রিয়ভাষিণীকে রাখা হয় ল্যাবএইডের হিমঘরে। অপেক্ষা তার ছেলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কাজী শাকের তুর্য্যর জন্য। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে কারু তিতাস বলেন, আজ বুধবার রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ঢাকায় পৌছাবেন তার ভাই। আগামীকাল মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে তাদের মাকে।
অসুস্থতাসহ মৃত্যুর সময়েও মায়ের পাশে ছিলেন কারুতিতাস। হাসপাতাল থেকে পিংকসিটিতে মেয়ে ফুলেশ্বরী নন্দিনীর বাসায় নিয়ে গোসল করানো হয় প্রিয়ভাষিণীকে। পিংক সিটি জামে মসজিদে হয় তার প্রথম জানাজা। এরপর তাকে আবার নিয়ে এসে রাখা হয় হাসপাতালের হিমঘরে।
মাকে হিমঘরে রেখে ফিরে যান তিতাস। কিন্তু দূরত্বটা কেবল বোধ হয় শারীরিকভাবেই, মাতো রয়েছে সন্তানের পুরোটা জীবনজুড়ে। আর তাই মা যখন হিমঘরে তখন সন্তান কারু তিতাস রাত ১ টা পাঁচ মিনিটে লেখেন, ‘সারা রাত ছবি এঁকে সকালে মাকে দেখাতাম। মা আমার জল রং খুব ভালোবাসতো। শিশুর মতো বলতো এটা আমাকে দিয়ে দে। বোলতাম সব ছবিই তো তোমার।
মা এখন অন্য আলোয়ে !!! সকালে আমি আর কাউকে কখনো ছবি দেখাবো না। শুরু হলো আমার এক অর্থহীন জীবন ।’
সারাবাংলাকে কারুতিতাস বলেন, আমিতো মা নির্ভর ছিলাম। কিন্তু মা তো চিরদিন থাকে না, কিন্তু আমি মিনিংলেস হয়ে গেলাম-। ফোনে কথা হচ্ছিলো কারুতিতাসের সঙ্গে, কিন্তু তার শূণ্য কণ্ঠের আকুল করা হাহাকার বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ছবি :কারু তিতাসের ফেসবুক থেকে
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ