নদী ভাঙনে বিলীন হবে আড়াই হাজার হেক্টর এলাকা— গবেষণায় আশঙ্কা
১৬ জুলাই ২০২০ ২০:৩১
ঢাকা: চলছে বর্ষা মৌসুম। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও কোথাও আবার বন্যা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। এতে বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক এলাকায় শুরু হয়েছে নদী ভাঙন। এমনকি পানি কমার সময় নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করবে। গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এক আগাম বার্তায় বলেছে, এবার নদী ভাঙনে আড়াই হাজার হেক্টর এলাকা বিলীন হতে পারে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত এবং পানি বাড়বে- তাতে ভাঙবে নদীর তীরও। এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর এই পরিস্থিতিকে মৌসুমি বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা বলছে। কিন্তু এই মৌসুমি বন্যায়ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ১৭ জেলা। যদিও মূল বন্যা এখনও শুরু হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতে সামনের দিনগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেজন্য সরকার আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার নদী ভাঙন ঠেকাতে এবং বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
২০০৪ সাল থেকে নদ-নদী ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। আর এই পূর্বাভাসের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মিলেও যায়। সিইজিআইএস’র এবারের পূর্বাভাস বলেছে, এ বছর নদ-নদীর ভাঙনে ২ হাজার ৩৬৫ হেক্টর এলাকা বিলীন হবে। এর মধ্যে ৩৬৫ হেক্টর বসতি এলাকা, ৫ হাজার চারশ’ মিটার সড়ক, ৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৯টি মসজিদ, তিনটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, তিনটি হাটবাজার, দুটি সরকারি ভবন ও একটি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নদ-নদীর চিত্র ধারণ, মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা আর আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস- এই তিনটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করে নদ-নদীর ভাঙন সম্পর্কে এই পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
সিইজিআইএস’র হিসাবে, ২০২০ সালে দেশের ১২ জেলার ১৬ এলাকায় নদী ভাঙন হবে। আর ওই ১৬ এলাকার প্রায় ২৩ হাজার মানুষ গৃহহীন হবে। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, গঙ্গা, যমুনা ও পদ্মা এই তিন নদীর ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন তারা। পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার যমুনা নদীতে ১১টি স্থান, গঙ্গায় চারটি এবং পদ্মা নদীতে একটি স্থান ভাঙতে পারে। যেসব এলাকা নদী ভাঙতে পারে তার মধ্যে রয়েছে- সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার খুকনিকটা, কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজীবপুর উপজেলা, টাঙ্গাইলের নাগরপুর ও সলিমাবাদ চর, পদ্মা নদীর অংশে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট, পাংশা উপজেলা। এরই মধ্যে এই এলাকাগুলোর কিছু অংশে ভাঙন শুরু হয়েছে। এছাড়া জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ফরিদপুর এবার তীব্র ভাঙনের কবলে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে কথা হয় সিইজিআইএস’র নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খানের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা শুষ্ক মৌসুমে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ইমেজ সংগ্রহ করি। সে ইমেজ দেখে নদীর গতিবেগ ও পথ পর্যালোচনা করে একটা মেথড ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্স বের করি। আমরা নদ-নদীর গতিবেগ ও পথ দেখে বুঝতে পারি এবার এই অংশ ভেঙেছে, পরের বছর ওই অংশ ভাঙতে পারে। স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে নলেজকে ট্যুল আকারে প্রকাশ করে ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর দেশের যমুনা, গঙ্গা এবং পদ্মা নদীর এক বছরের ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে আসছি আমরা। এই পূর্বাভাসে নদীর সব জায়গায় যে ভাঙবে তা নয়, যেসব জায়গায় ভাঙন খুব বেশি হতে পারে প্রতিবছর এরকম কিছু সম্ভাব্য স্থান নির্বাচন করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নদী হচ্ছে পলিবাহিত। এই তিন নদীতে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন টন সেডিমেন্ট আসে। এর মধ্যে বালি থাকে, ক্লেও থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজাইনে নতুনত্ব আনার কারণে নদী ভাঙন এখন অনেক কমেছে। এটি আরও কমাতে হলে পুরো নদীকে স্টাডি করতে হবে। এরপর ভাঙনের স্থান চিহ্নিত করতে হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে ভাঙন আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।’
‘তবে এই উৎকন্ঠার মধ্যেও আশাব্যাঞ্জক সংবাদ যে, দিন দিন নদী ভাঙন কমে আসছে। ২০১১ সালে দেশে বছরে ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর এলাকা নদী ভাঙনের শিকার হয়েছিল। সাত বছর পর ২০১৮ সালে তা কমে ৩ হাজার ২০০ হেক্টরে নেমেছে। গত বছর ছিল ২ হাজার ৬০০ হেক্টর’— বলেন মালিক ফিদা এ খান।
জানা যায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া, সিরাজগঞ্জের চৌহালী, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেবীগ্রাম এলাকায় রেকর্ড পরিমাণ নদী ভাঙনের শিকার হতো। গত কয়েক বছরে এসব এলাকায় নদী ভাঙন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এবারের ভাঙনের পূর্বাভাসেও এসব এলাকার নদ-নদীর নাম নেই।
এ প্রসঙ্গে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালে নড়িয়াতে সাড়ে ৫ হাজার বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাঁচতলা ভবন, হাসপাতাল, স্কুল থেকে শুরু করে বাড়িঘর ও চাষাবাদের জমি চলে গেছে নদী গর্ভে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দেড় বছরে ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ৫৪টি স্থান পরিদর্শন করেছি। হাতিয়া, সন্দীপ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সাতক্ষীরার গাবুরা, খুলনার কয়রা, কক্সবাজারের নদী ভাঙন এলাকা, চাঁদপুর ও কমলনগরে গিয়েছি। ওইসব এলাকার সমস্যা জেনেছি এবং ব্যবস্থা নিয়েছি।’
এনামুল হক বলেন, ‘গত বছর সিইজিআইস ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়েছিল। এবার ১৬টি এলাকার পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থাৎ এবার চারটা কমেছে। যে ১৬টি এলাকার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে সেসব এলাকা আমরা পরিদর্শন করেছি। ওইসব এলাকায় পর্যাপ্ত কর্মকর্তা সব সময় মনিটরিংয়ে জন্য রাখা হয়েছে। টাস্কফোর্স দিগুণ করা হয়েছে।’
নিজেকে নদী ভাঙন এলাকার মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িও নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অন্যত্র বাড়ি করে থাকছি। আমি জানি, এই নদী ভাঙন সর্বস্ব কেড়ে নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ রয়েছে- নদী ভাঙন ও হাওর এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ব্যবস্থা নিতে। সেভাবেই আমরা কাজ করছি। আর সেজন্যই ভাঙন কমে আসছে।’
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী বলেন, ‘জরুরি যেসব ভাঙন আসে সেগুলোর জন্য তাৎক্ষণিক জিও ব্যাগ ডাম্পিং তো রয়েছেই। স্থায়ীভাবে করলে সিসি ব্লক করে দেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজাইনে নতুনত্ব এনেছি। এডিজি দিয়েছি পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল জোনে ভাগ করে। টাস্কফোর্সকে ডিসেন্ট্রালাইজড করে দিয়েছি। আটটি জোনে আটজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে ভাগ করে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘১৬টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্থায়ী প্রকল্প নেওয়া আছে। চাঁদপুর, গাইবান্ধা, রাজবাড়ীতে প্রকল্প নেওয়া আছে। আমি ছাত্ররাজনীতি করে এসেছি। কোনো কাজে হাত দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আমি স্পটে যাই। সেখানে গিয়ে মিটিং করি তারপর সিদ্ধান্ত নিই। এতে কাজ করতে সুবিধা হয়।’
এই করোনা পরিস্থিতিতেও এবারের বাজেটে বন্য ও নদী ভাঙন রোধে হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানান এনামুল হক।
আড়াই হাজার হেক্টর আশঙ্কা এনামুল হক গবেষণা নদী ভাঙন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী মালিক ফিদা এ খান সিইজিআইএস