Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অনলাইন ক্লাস তৈরি করছে ‘বৈষম্য’— মত ঢাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের


১৭ জুলাই ২০২০ ১৫:৫৫

চলতি জুলাইয়ের শুরু থেকেই পুরোদমে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিকাংশ বিভাগ। তবে শিক্ষার্থীদের অনেকেই নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে অংশ নিতে পারছেন না এসব ক্লাসে। প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সমাধান না করেই অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে যাওয়াকে স্পষ্টতই ‘বৈষম্য’ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করাই কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ‘বৈষম্য’ তৈরির বিষয়টির সঙ্গে একমত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামও।

বিজ্ঞাপন

গত মে মাসের শুরুর দিকে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাবি প্রশাসন। পরে জুন মাসের শেষের দিকে এই সিদ্ধান্ত বদলে যায়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগ।

বিভাগগুলোতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছেন না বলে অভিযোগ আসতে থাকে। জানা যায়, প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকা, নেটওয়ার্ক সমস্যা , অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাসে ‍যুক্ত হতে পারছেন না এসব শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভাগটির স্নাতক পর্যায়ে চারটি ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চলমান একটি ব্যাচে মোট শিক্ষার্থীর দুই-তৃতীয়াংশেরও কম শিক্ষার্থী নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছেন। এছাড়া একই অনুষদের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগসহ প্রায় সবক’টি বিভাগেই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা। এদিকে বিজ্ঞান অনুষদ, কলা অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের বিভাগগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট অংশ একেবারেই যুক্ত হতে পারছেন না।

বিজ্ঞাপন

অনলাইন ক্লাস সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো নির্মাণ ও আর্থিক সংশ্লেষসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গত জুন মাসের ২৫ তারিখে উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল সারাবাংলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত অধিকাংশ বিভাগ ও অনুষদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। গুটিকয়েক বিভাগ ও অনুষদ তথ্য দিয়েছে। সবগুলো অনুষদ বা বিভাগের তথ্য হাতে আসার আগ পর্যন্ত কিছু বলা হচ্ছে না। আশা করি আগামী সপ্তাহে সব তথ্য হাতে আসবে। এরপর কম্পাইল করে শিক্ষার্থীদের চাহিদা, সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে।

বর্তমানে জুম, গুগল মিটস অনলাই কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিভাগগুলো অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, যারা প্রত্যন্ত বা গ্রাম এলাকায় বাড়িতে অবস্থান করছেন, তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর। আর মোবাইল নেটওয়ার্ক দিয়ে অ্যাপ্লিকেশনগুলো যথাযথভাবে চালাতে পারছেন না। এছাড়া এ ধরনের অ্যাপগুলোতে ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৬০০ মেগাবাইট ডাটা খরচ হয়ে থাকে, এর ব্যয়ভার বহনের মতো যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতাও অনেকের নেই।

দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার গ্রামে নেটওয়ার্ক অনেক দুর্বল। তাছাড়া প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়শ মেগাবাইট ডাটা কিনতে অনেক খরচ। বাড়িতে কর্মহীন বসে থেকে এত টাকা জোগানো সম্ভব না।’

কাজী মিঞা জানালেন, তার বিভাগের অনেকেই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তার ব্যাচের ১৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে অনলাইনে ক্লাস করতে পারছেন ১২০ জন। অর্থাৎ ৫০ জনই ক্লাস করতে পারছেন না।

থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ওবায়দুর রহমান সোহান বলেন, আমার বন্ধুদের অনেকের কাছেই অনলাইন ক্লাস করার মতো ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন নেই। আবার কারও কারও স্মার্টফোন থাকলেও অনলাইনে ক্লাস করার মতো শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এখন তো দেশের অনেক জেলায় বন্যা চলছে। ওই সব এলাকায় যারা আছে, তাদের এই বন্যাকবলিত অবস্থায় অনলাইনে ক্লাস করতে বলাটা অমানবিকতা। সেক্ষেত্রে আমার যেসব বন্ধু ক্লাস করতে পারছে না, তাদের বঞ্চিত রেখে ক্লাস চালিয়ে যেতে থাকলে সেটা স্বার্থপর ও নিষ্ঠুরতা হবে বলে মনে হয়। এটা বৈষম্য।

যারা ক্লাস করতে পারছে না, এ তো গেল তাদের কথা। যারা ক্লাস করছে, তাদের অভিজ্ঞতা কেমন? জানতে চাইলে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান জাবের বলেন, স্ট্যাবল ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ক্লাস করার সময় বারবার নেটওয়ার্ক ড্রপ হয়, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক সময় শিক্ষকদের ওই পাশ থেকেও একই সমস্যা দেখা যায়। লেকচার বোঝা কঠিন হয়ে যায়। এগুলোর কোনো সমাধান পাচ্ছি না। ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থীও নানা সীমাবদ্ধতায় অংশ নিতে পারছে না। তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি কী হবে, তাও বুঝতে পারছি না।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার আগে যথেষ্ট সময় থাকা সত্ত্বেও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি বলেই অনেক শিক্ষার্থী ‘বঞ্চনা’ ও ‘বৈষম্যে’র শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন ঢাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্লাস নিতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে। কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে যুক্ত হতে পারছে না। মূলত অনলাইন ক্লাসের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় ছিল। পরে কোনো এক কারণে এই কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর জন্য প্রস্তুতিটাই ঠিকমতো নেওয়া হয়নি। ফলে কিছু কিছু শিক্ষার্থী বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য অনলাইন ক্লাস কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সে উপায় বের করে তবেই অনলাইন ক্লাস চালিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ক্লাস নিতে গিয়ে দেখেছি, ২৫ থেকে ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে যুক্ত হতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে ডিজিটাল এই পদ্ধতি তো বৈষম্য তৈরি করছে। একটি ক্লাসের তিন বা চার ভাগের একভাব শিক্ষার্থীকে পাঠদানের বাইরে রেখে তো আমরা এগিয়ে যেতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা। এভাবে চলতে থাকলে প্রান্তিক এলাকার শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পিছিয়ে পড়বে।

অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক বা আর্থিক বা অন্য কারিগরি জটিলতা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসের বিকল্প নেই বলেই মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। সেক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে বিকল্প উপায়ে ‘ম্যাটেরিয়াল’ পৌঁছে দেওয়াকে একটি সমাধান হিসেবে মনে করছেন।

ড. কায়কোবাদ সারাবাংলাকে বলেন, এটা সত্য— যেসব অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল, সেসব অঞ্চলে এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো চালানো কঠিন। অর্থের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও আছে। সেক্ষেত্রে কেবল অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পরিবর্তে এইসব শিক্ষার্থীদের কাছে অন্য কোনোভাবে ক্লাস ম্যাটেরিয়াল পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা মেইলের মাধ্যমে ফাইল আকারে হতে, কিংবা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। কিন্তু, কোনোভাবেই অনলাইন ক্লাস বাদ দিয়ে বসে থাকা যাবে না। তবে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তার সমাধান না করেই ক্লাস চালিয়ে যাওয়াটা স্পষ্টতই বৈষ্যম্য— এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই ‘ডিজিটাল বৈষম্য’ দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারকেও সহায়তা করার আহ্বান জানালেন ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন এই ধরনের বৈষম্য তৈরি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে সহায়তা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একা না পারলে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত হবে, যেসব শিক্ষার্থী অসুবিধার মধ্যে আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দ্রুত তাদের সহায়তা দেওয়া, প্রয়োজনে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের টাকা খরচ হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, এটি কোনো বাজে খরচ হবে না, বরং শিক্ষা খাতের এই খরচ হবে একটি ভালো বিনিয়োগ।

অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস অনলাইন ক্লাস অনলাইন ক্লাসে বৈষম্য আর্থিক সক্ষমতা ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্বল নেটওয়ার্ক মোবাইল নেটওয়ার্ক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর