দেশের সড়ক-বন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য পরিবহন, আশাবাদী ব্যবসায়ীরা
১৮ জুলাই ২০২০ ১৭:২৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের পরিবহন-সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে দেশটির পণ্য নিয়ে যাওয়া শুরু হচ্ছে চলতি সপ্তাহেই। প্রথম চালানের ওপর নির্ভর করছে এই ট্রান্সশিপমেন্ট পদ্ধতিতে পণ্য পরিবহনে ভারতের ব্যবসায়ীরা আগ্রহী কি না। তবে ট্রান্সশিপমেন্ট এর বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরাও।
ব্যবসায়ীদের মতে, ট্রান্সশিপমেন্ট পদ্ধতি পুরোপুরি চালু হলে মাশুল আদায়ের পাশাপাশি বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে বাণিজ্য বাড়বে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের মতো আন্তর্জাতিক কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সেক্টরে প্রবেশ করবে। এতে বন্দরের সক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার হবে, আয় বাড়বে, পাশাপাশি বন্দরের দক্ষতাও বাড়বে।
পণ্যবাহী চারটি কনটেইনার নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের ভূখণ্ডে পণ্য পরিবহন। চট্টগ্রামে ভারতের সহকারি হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর থেকে চারটি কনটেইনার নিয়ে জাহাজ দেশটির হলদিয়া বন্দরে পৌঁছেছে। সেখানে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কনটেইনার তোলা হচ্ছে।
বিরূপ আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল থাকায় জাহাজটিতে কনটেইনার ওঠানামায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে শনিবার (১৮ জুলাই) রাতে জাহাজটি বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা রয়েছে। ২১ জুলাই (মঙ্গলবার) নাগাদ জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের পর চারটি কনটেইনার সড়কপথে আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে যাবে।
ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য এমভি সেঁজুতি নামে জাহাজটি গত ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দরে গিয়ে পৌঁছে। পরদিন সেটি কলকাতা বন্দরের জেটিতে বার্থিং নেয়।
জাহাজটির এদেশীয় এজেন্ট ম্যাঙ্গো শিপিং লাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইয়াকুব সুজন ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘হলদিয়া বন্দর থেকে আজ (শনিবার) রাতে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেবে। আশা করছি, সোমবার রাতে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে পৌঁছাবে। বার্থিং কমিটির শিডিউল পেলে মঙ্গলবার সেটি জেটিতে আসবে এবং কনটেইনার খালাস শুরু করবে।’
তিনি জানিয়েছেন, ভারতের চারটি কনটেইনারের পাশাপাশি বাংলাদেশি আমদানিকারকদের ১০৪টি কনটেইনারও ওই জাহাজে করে আসার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রামে ভারতের সহকারি হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের চারটি কনটেইনারের দুটিতে রড এবং অপর দুটিতে ভোগ্যপণ্য ডাল আছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে কনটেইনার চারটি খালাসের পর সরাসরি বাংলাদেশি প্রাইম মোভারের মাধ্যমে পৌঁছানো হবে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়া স্থলবন্দরে। সেখানে খালাসের পর রডের চালান নেওয়া হবে পশ্চিম ত্রিপুরার জিরানিয়ায়। চালানটি ভারতের এস এম করপোরেশনের। এছাড়া ডালের চালান নেওয়া হবে আসামের করিমগঞ্জে জেইন ট্রেডার্সের কাছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত এক দশকে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। বন্দরে এখন জাহাজ ও কনটেইনার জট নেই। ভারতীয় পণ্য নিয়ে যে জাহাজ আসবে সেটি তো বাংলাদেশ-ভারত চুক্তির আওতায় আসবে। এক্ষেত্রে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থিং কমিটি বার্থিং নীতিমাল অনুযায়ী এবং চুক্তি মোতাবেক সেটিকে পণ্য খালাসের জন্য জেটিতে আসার শিডিউল দেবে। চুক্তি অনুযায়ীই চট্টগ্রাম বন্দর সব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রস্তুত আছে।’
এদিকে ভারতীয় পণ্য খালাসের জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত ধরনের মাশুল আদায় করবে। চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় পণ্যের প্রতি চালানের প্রসেসিং ফি বাবদ ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ৩০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা, এসকর্টের চার্জ ৫০ টাকা এবং বিবিধ প্রশাসনিক মাশুল ১০০ টাকা। এছাড়া প্রতি কনটেইনার স্ক্যানিংয়ের জন্য ২৫৪ টাকা এবং বিধি অনুযায়ী ইলেকট্রিক সিল ও লক মাশুল দিতে হবে ভারতকে। বাংলাদেশ প্রতি কনটেইনারে পাবে ৪৮ থেকে ৫৫ মার্কিন ডলার। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দরও তাদের মাশুল আদায় করবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত পরিবহন খরচও পাবে বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, ‘দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী কাস্টমস যেসব মাশুল আদায়ের এখতিয়ার রাখে সেগুলো আমরা আদায় করবো। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে।’
২০১৮ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহনের চুক্তি হয়। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠকে এ সংক্রান্ত পরিচালন পদ্ধতি স্বাক্ষর হয়। এর নয় মাস পর পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হতে যাওয়া এই ট্রান্সশিপমেন্টে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখছেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী আমদানি-রফতানিকারকেরা।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি এম এ সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রায়াল বেসিসে একটা চালান আসবে। আমরা চাইবো, ট্রান্সশিপমেন্টটা যাতে পুরোপুরি চালু হয়। কারণ পৃথিবীর অনেক ল্যান্ডলকড কান্ট্রিকে বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে বিপুল আয় করছে বিভিন্ন দেশ। আফগানিস্তানের সমস্ত পণ্য পাকিস্তানের বন্দরের মাধ্যমে খালাস হয়। পাকিস্তান অনেক টাকা আয় করছে। দেশীয় বাণিজ্যের ক্ষতি না করে বন্দরের ব্যবহার যত বাড়ানো যায়, ততই ভালো। স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। সেই সক্ষমতার পুরোটা তো আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। যে কোনো ইক্যুইপমেন্টের মেইনটেনেন্স পিরিয়ড আছে। বিদ্যমান ব্যবহারের চাইতে এটার ব্যবহার যদি বাড়ে, আয়ও তো বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে একটা বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বাড়বে। কারণ এতদিন তারা লোকালি কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে। এখন তারা ইন্টারন্যাশনাল কার্গো হ্যান্ডলিং করবে। কলম্বো পোর্ট যদি ১৪০০-১৫০০ কনটেইনার দুইদিনে হ্যান্ডলিং করতে পারে, আমাদের বন্দরে মাত্র ৪০০-৫০০ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে কেন তিন-চার দিন লাগবে? এখন যখন ইন্টারন্যাশনালি কার্গো হ্যান্ডলিং করতে হবে, তারা আরও তৎপর হবেন’-বলেন এম এ সালাম।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুঝে না বুঝে অনেকে ট্রান্সশিপমেন্টের বিরোধিতা করে আসছেন। অনেকে নেতিবাচক মনোভাব কিংবা ভারতবিরোধী রাজনীতি থেকে এটা করছেন। কিন্তু এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা কন্টিনিউ করলে প্রতিবেশি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি নেপাল-ভূটানের পণ্যও তো একইভাবে পরিবহন সম্ভব। এতে আমরা মাশুল পাব, গাড়ি ভাড়া আছে, অবকাঠামো ব্যবহার করে সেটার ভাড়া পাব, শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্র বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নটা হবে। সড়ক এবং রেলপথের উন্নয়ন হবে। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা থাকবে।’