ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দেশের অর্থনীতি
২১ জুলাই ২০২০ ২২:২৬
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের গতি এখনো কমেনি। তবে এর মধ্যেই ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে দেশে। এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ‘ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা’ করছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ‘সাধারণ ছুটি’র সময় অর্থনীতির গতি যেখানে শূন্য শতাংশে নেমে গিয়েছিল, বর্তমানে তা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে ফিরে এলেও আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি বলে মন্তব্য করছেন কেউ কেউ।
এদিকে, কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, করোনার প্রভাবে ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে অনেকই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, লকডাউন অবস্থায়ও যা দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের ঢল বাড়ছে গ্রামের দিকে। দেশে শপিং মল, পর্যটন, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন কেন্দ্র ও সিনেমা হলসহ এখনো সচল হয়নি সব খাত। বহির্বিশ্বেও মন্দাভাব বিরাজ করছে। শঙ্কা রয়েছে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স নিয়ে। ফলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো শঙ্কা রয়েই গেছে।
আরও পড়ুন- রেমিট্যান্স-রিজার্ভের রেকর্ডেও স্বস্তি পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা
দেশের অর্থনীতি নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে সোমবার (১৯ জুলাই) অর্থনীতিবিদরা এমন মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, সারাদেশে সবাই সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানলে অর্থনীতির চিত্র এতটা খারাপ হতো না। আর এখন ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা, সেক্ষেত্রেও পূর্ণ গতি ফিরে পেতে হলে প্রথমে প্রয়োজন করোনা সংক্রমণের গতি নিয়ন্ত্রণ করা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, দেশের অর্থনীতি আগে যে অবস্থায় ছিল, এখন সেই অবস্থায় যাওয়া সম্ভব না। তবে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে বিশ্বজুড়ে যে সংকট ছিল, সেই সংকটও নেই। ফলে নতুন এক বাস্তবতায় অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক দেশই এখন তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছে। তখন রাস্তায় রিকশা ছিল না, এখন আছে। এখন একটি নিউ নরমাল পরিস্থিতি। ফেব্রুয়ারির আগে অর্থনীতি যে গতিধারায় ছিল, সেখানে এখন নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। সেটি আগের চেয়ে দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার চেয়ে এখন অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। এখন প্রবৃদ্ধি নয়, উৎপাদন, বাণিজ্য ও বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে হবে বেশি। সরকার ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা। অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এখন পূর্বশর্ত স্বাস্থ্য খাতের পুনর্গঠন। এছাড়া করোনার কারণে প্রযুক্তি, কৃষি, টেক্সটাইল ও ওষুধ খাতে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। এগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। অর্থাৎ অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়ায়নি, বরং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।’
আরও পড়ুন- কর্মহীন পেশাজীবীদের গ্রামে ফেরা ‘ভালো ইঙ্গিত’— মত অর্থনীতিবিদদের
জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। লকডাউন উঠিয়ে দিলেও অর্থনীতি এখনো জমে ওঠেনি। তারপরও গত কয়েক সপ্তাহে কনস্ট্রাকশন, মোবাইল, আইসিটি পণ্যসহ বেশকিছু খাতের বিক্রি বাড়তে শুরু করেছে। এপ্রিলে যেখানে রফতানি আয় ৩৫০ মিলিয়নে নেমে এসেছিল, এখন তা বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ অর্থনীতির গতি আগে যেখানে শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল, তা এখন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে করোনার আগে যেমন গতি ছিল এখনো সেই গতি অর্জন করতে পারেনি।’
এখনো ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি’ তৈরি না হওয়াকেই দেশের অর্থনীতির আগের অবস্থায় যেতে না পারার কারণ হিসেবে মনে করছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে করোনার আগে অর্থনীতি যে অবস্থায় ছিল, এখনো সেই জায়গায় যায়নি। কারণ দেশের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। রফতানি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। পুরোনো ক্রয়াদেশও ফিরে আসছে। রফতানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকের অবস্থা ভালো হচ্ছে।’
বিপরীত দিকের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যেসব পণ্যের বেচাকেনা কম, সেসব ব্যবসায়ীরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। অনেকেই জীবিকা হারাচ্ছেন, গ্রামে ফিরছেন। এখন যে হারে কর্মহীনতা দেখা যাচ্ছে, লকডাউন অবস্থাতেও দেশে এমন কর্মহীনতা দেখা যায়নি। ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা এখন কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন।’ সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাধারণ মানুষ করোনা মোকাবিলায় সচেতন ও সতর্ক থাকলে এবং সরকার স্বাস্থ্য খাতে সফলতা দেখাতে পারলে ‘বিপরীতমুখী’ এই ধারা অনেকটাই কমানো যেত বলে মন্তব্য এই অর্থনীতিবিদের।
বর্তমান পরিস্থিতিতেও অর্থনীতিতে গতিশীল রেখে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে স্বাস্থ্য খাতে সফলতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, “অর্থনীতি এখনো পরিপূর্ণভাবে ঘুরে দাঁড়ায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনীতির চাকা সচল হওয়া শুরু করেছে। মানুষ এখনো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছে না। স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনে যদি সংক্রমণটা কিছু কমানো যায়, সংক্রমণ যদি স্থিতিশীলভাবে কমতে থাকে, তাহলে অর্থনীতি ‘রিকভারি ফেজ’ অতিক্রম করে পূর্ণোদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে।”
অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ থাকলেও বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেশকিছু চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর। তিনি বলেন, ‘এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বৈশ্বিকভাবে মন্দা রয়েছে, বিশেষত রফতানি খাতের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন প্যাকেজ বা প্রণোদনা বাস্তবায়নে ধীর গতি রয়েছে। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে যদি ব্যক্তি খাতকে চাঙ্গা করা যায়, তাহলে হয়তো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হবে। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে। সবমিলিয়ে অর্থনীতি নিয়ে এখন সর্তক আশাবাদ রয়েছে।’
তবে করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। সহসাই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন না তিনি।
মির্জ্জা আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা একদিন কমলে আরেকদিন বাড়ছে। সংক্রমণও সেই হারে কমছে না। এ অবস্থায় অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে না। এরই মধ্যে ইতালিতে আবারও করোনা বাড়ছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও বিছিন্ন রয়েছে। আমেরিকার বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। এই অবস্থায় রফতানি আয়ে খুব একটা সুখবর দেখা যাচ্ছে না। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও অনেক দেশে প্রবাসীরা খারাপ অবস্থায় রয়েছে। অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। রফতানি ও রেমিট্যান্সের অবস্থা যদি ভালো না হয়, তাহলে খুব একটা ভালো কিছু আশা করা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে কৃষি খাতে বেশ ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে এখন বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম।’
অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজও এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনতে তিনি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে বলছেন। ড. রিয়াজ বলেন, ‘ভাইরাস ম্যানেজম্যান্ট করে করোনা যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে অর্থনীতির এখনকার যে ধীরগতি, তা অনেক দিন ধরে দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে আগের গতিতে ফিরিয়ে আনতে হলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণটা আগে জরুরি।’
অর্থনীতি অর্থনীতিতে করোনার ধাক্কা অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান করোনাভাইরাস করোনাভাইরাসের প্রভাব কোভিড-১৯ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউ নরমাল রফতানি আয় রেমিট্যান্স