বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা, খাল পুনরুদ্ধারে শত কোটি টাকা জলে
২২ জুলাই ২০২০ ১৩:০৩
ঢাকা: বর্ষা মানেই আষাঢ়-শ্রাবণে মুষলধারায় বৃষ্টি। এই বর্ষায় তুমুল বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় ভাসে দেশ। যদিও রাজধানী ঢাকায় বর্ষার আবহে বন্যা আসে না কোনোদিনই; কিন্তু একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা যে রূপ নেয় তাতে বন্যার চেয়ে কমও বলা যায় না। আর এই জলাবদ্ধতার মূল কারণ হলো রাজধানীর খাল ও নালা হারিয়ে যাওয়া। রাজধানীতে খাল ও নালা দখলের ঘটনা চিরাচরিত। ক্ষমতার দাপটে অনেকেই এগুলো দখল করে গড়ছে আবাসন। ফলে ভেঙে পড়েছে পুরো ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। খাল পুনরুদ্ধারে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে ওয়াসা। কিন্তু এর জন্য শত কোটি টাকা খরচ হলেও উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং জলাবদ্ধতা দিন দিন আরও বেশি অসহনীয় করে তুলছে ঢাকাবাসীকে।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বর্তমান যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে পানি নামতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। আর ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যনুযায়ী, সোমবার (২০ জুলাই) রাতে কয়েক ঘণ্টায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর মঙ্গলবার (২১ জুলাই) সকালের তিন ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৬৩ মিলিমিটার। এতে পানি জমে রাজধানীর অনেক এলাকা ডুবে যায়। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, বর্ষা মৌসুমে এই পরিমাণ বৃষ্টি স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক বৃষ্টিতেও জলজটে নাজেহাল নগরবাসী। এই পরিস্থিতিতে বুধবার (২২ জুলাই) দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রধানদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী।
আইন অনুযায়ী খাল, নর্দমা, ড্রেন সংস্কারসহ রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছয় প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। ছয়টি প্রতিষ্ঠান হলো- ঢাকা ওয়াসা, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। এর বাইরেও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করে। তবে মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার।
এদিকে ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি খাল বা বড় নালা দিয়ে নেমে যায়। কিন্তু সেসব বন্ধ থাকলে পানি নামতে পারে না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, ওয়াসার অধীনে পানি নিষ্কাশনের জন্য বড় নালা রয়েছে ৩৮৫ কিলোমিটার, বক্স কালভার্ট ১০ কিলোমিটার আর ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খাল রয়েছে ২৬টি। এসব পুনরুদ্ধারে গত তিন বছরে খরচ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। তারপরও কমেনি জলাবদ্ধতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক কর্মকর্তা সারাবাংলা বলেন, ‘পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে ওয়াসা ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ওপর ভরসা করে অনেক কাজই শেষ করতে পারিনি।’ তিনি জানান, ‘ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারও ও খাল উন্নয়ন প্রকল্প’ এবং ‘হাজারীবাগ, বাইশটেকী, কুর্মিটোলা, মান্ডা ও বেগুনবাড়ি খালের ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প’ নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। অথচ এই প্রকল্প দুটির মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও এর অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। অথচ এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে যেত।
অন্যদিকে রাজউক গোটা নগর পরিকল্পনার পাশাপাশি হাতিরঝিল, উত্তরা, গুলশান বনানী এলাকার সব খাল দেখভাল করে। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজধানীর চারিদিকে স্লুইসগেট রক্ষণাবেক্ষণ করে। সেনানিবাস এলাকার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব পালন করে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। এদের দায়িত্ব বন্টন করার পরও প্রতিবছর বর্ষায় জলে ভাসতে হয় রাজধানীবাসীদের। এর জন্য ওই ছয় সংস্থার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এ প্রসঙ্গে নগর গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি আদর্শ শহরে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত এলাকা এবং ১৫ ভাগ জলাধার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে উন্মুক্ত এলাকা নেই বললেই চলে। যা ছিল তা দিন দিন ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়ছে। ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসবের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু তাদের বক্তব্য ও কাজে পরিবর্তন দেখা যায় না। ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে সৈয়দ আশরাফ থাকলেও এসব কাজ দেখভাল করতেন ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বো থাকা জাহাঙ্গীর কবীর নানক। তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিনের সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব না। তবে রাজধানীবাসীকে আর পানিতে ভাসতে হবে না।’ তারপরে মন্ত্রীর দায়িত্বে এসে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনও ২০১৭ সালে এমন ভরা বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিয়ে বলেছিলেন, ‘মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি, দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়।’ তবে প্রতিজ্ঞা করে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘পরের বছর পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা হচ্ছে।’ কিন্তু তারপর পেরিয়ে গেছে ৩ বছর।
বর্তমানে দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামও দায়িত্ব নিয়ে একই কথা বলেছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার সময়ও এর মধ্যে দেড় বছর পার হয়েছে। কিন্তু সমস্যা রয়েই গেছে। এদিকে মঙ্গলবার (২১ জুলাই) নিজ দফতরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে। এ নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে।’ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘৪০টি খাল পুনরুদ্ধার করা হবে। এসব কাজ শেষ হলে রাজধানীতে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না।’ এছাড়াও রাজধানীর চারপাশের চারটি নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়া অংশে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।