বাকি জীবনটা এতিমদের সঙ্গে কাটাব: বিদায়ী বিচারপতি ভবানী প্রসাদ
২৩ জুলাই ২০২০ ২০:৩৫
ঢাকা: ‘জীবনে বাকি সময়টুকু এতিমদের সঙ্গে থেকে তাদের ভালোবাসা নিয়ে বিদায় নিতে চাই। এতিমখানায় আমার হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে আছে। আমি তাদের সঙ্গেই শেষ সময়টুকু কাটাতে চাই।’
বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) বিচারিক জীবনের শেষ কার্যদিবসে অনলাইনে আইনজীবীদের সংবর্ধানায় বিচারিক জীবনের বিদায়ী ভাষণে এসব কথা বললেন বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ। হাইকোর্ট থেকে অবসরে যাওয়া এই বিচারপতি আলোচিত সাত খুন মামলায় হাইকোর্টের রায় দিয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিনসহ শতাধিক আইনজীবী অনলাইনে যুক্ত হয়ে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহকে সংবর্ধনা দেন।
করোনার এই সংকটের মধ্যেও আন্তরিকতা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ। তিনি বলেন, বার ও বেঞ্চ একে অন্যের পরিপূরক। বার ছাড়া যেমন বেঞ্চের অস্তিত্ব থাকে না, তেমনটি বেঞ্চ ছাড়া বারের অস্তিত্ব থাকে না। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এবং বিচারপ্রার্থী জনগনকে সুষ্ঠ ও ন্যায় বিচার প্রদানের জন্য বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা অত্যন্ত আবশ্যক।
তিনি বলেন, আমার কার্যক্রমে আমি আপনাদের সঙ্গে সুন্দর ও সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। আদালতের কার্যক্রমে আপনারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সেজন্য আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
বিদায়ী এই বিচারপতি বলেন, আজকে থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ২০ এপ্রিল মুনসেফ পদে বিচার বিভাগে আমি যোগ দিয়েছিলাম। চাকরির চিরন্তন নিয়ম অনুযায়ী আজ চাকরি থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছি। আমি চাকরি থেকে বিদায় নিচ্ছি, এতে আমার কোনো কষ্ট নাই, মানসিক কোনো দুঃখ নাই। বরং আমি ভারমুক্ত। তবে যাদের সঙ্গে আমি এতদিন ছিলাম, তাদের ফেলে যেতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি আমার চাকরি জীবনে সম্পূর্ণ সৎ থেকে, ন্যায়-নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। কতটুকু করতে পেরেছি, আপনারা তার বিচার করবেন। আমি প্রকৃতিপক্ষে আপনাদেরই একজন। কেননা প্রথমে চার বছর সিভিল আইনজীবী হিসেবে সিলেট জেলা জজ আদালতে প্র্যাকটিস করেছি। তারপর আমি বিচার বিভাগে যোগ দিয়েছি। চাকরি জীবনে সবসময় চেষ্টা করেছি কোনো আইনজীবীর মনে কোনো কষ্ট না দিতে। বরং সবসময় চেষ্টা করেছি তাদের সবসময় যথাযথ সম্মান করতে। এ বিষয়ে আমার অনিচ্ছাকৃত কোনো ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনারা আমার যে প্রশংসা করেছেন, তার কোনো যোগ্যতা আমার আছে কি না, আমি জানি না। তবে আপানাদের এ মূল্যায়ন আমার পরবর্তী জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে।
সিনিয়র আইনজীবীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ বলেন, আপনাদের সঙ্গে জুনিয়র আইনজীবীরা আছেন। তারা যেন বর্তমান সময়ে কঠিন সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুষ্ঠভাবে এবং সম্মানজনকভাবে বাঁচতে পারে, সেদিকে আপনারা খেয়াল রাখবেন। কেননা আমিও একদিন জুনিয়র আইনজীবী ছিলাম, তাই জুনিয়রদের দুঃখ আমি বুঝি।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হাইকোর্টের বিদায়ী এই বিচারপতি বলেন, বারের সভাপতি আমার এতিমখানার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা বলেছেন। উনাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলে ১১টি এতিমখানার সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা আছে। আমার হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে আছে। আমার শেষ ইচ্ছা, আমার শেষ জীবনে এতিম বাচ্চাদের মাঝে থেকেই তাদের ভালোবাসায় আমি বিদায় নিতে চাই। পরম সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার আন্তরিক প্রার্থনা, গোটা বিশ্বের সব মানুষকে এই মহামারি থেকে তিনি রক্ষা করুন। সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
এর আগে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার বক্তব্যে বলেন, বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ছিলেন একজন রুচিবান ও সংস্কৃতিবান মানুষ। ব্যক্তি পর্যায়ে তিনি ছিলেন একজন সাধু। তিনি ছিলেন সৎ। তার এ বিদায়ে বিচার বিভাগে একটি শূন্যতা তৈরি হবে।
বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বিচারপতি হিসেবে আপনার একটা গুণ ছিল— আপনি শুনানি শেষে সঙ্গে সঙ্গে রায় দিয়ে দিতেন। এতে বিচারপ্রার্থীসহ আইনজীবীরা বেশি খুশি হতেন।
বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহের জন্ম ১৯৫৩ সালের ৮ আগস্ট, সিলেট জেলার কোতোয়ালি থানার মাছিমপুর গ্রামে। বাবা সুদীশ চন্দ্র সিংহ, মাতা কৃষ্ণভানু রাজকুমারী।
ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করে পরে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন ভবানী প্রসাদ সিংহ। ১৯৭৯ সালের ১ মার্চ সিলেট জেলা বারে আইনজীবী হিসেবে তালিকভুক্ত হন। পরে ১৯৮৩ সালের ২০ এপ্রিল মুন্সেফ হিসেবে (সহকারী জজ) বিচার বিভাগে যোগ দেন। ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর তাকে দুই বছরের জন্য হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তার একজন সন্তান রয়েছেন তিনি বিদেশে থাকে। স্ত্রী অনেক আগেই পরলোক গমন করেছেন।
সংবিধান অনুসারে ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হলে অবসরে যান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। সেই অনুসারে ৭ আগস্ট ৬৭ বছর পূর্ণ হবে বিচারপতি ভবানী প্রসাদের। এর মধ্যে শুক্রবার (২৪ জুলাই) থেকে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শুরু হচ্ছে। এ কারণে আজ ছিল তার বিচারিক জীবনের শেষ কার্যদিবস।
বিচারিক জীবনে ভবানী প্রসাদ সিংহ অসংখ্য মামলার রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যা, জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক মোমিন, লক্ষ্মীপুরে স্কুলছাত্রী স্মৃতি নাথ সীমাকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং নরসিংদীর সিক্স মার্ডারের মতো আলোচিত মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর রায় দিয়েছেন তিনি।
বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ বিদায় সংবর্ধনা বিদায়ী বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ সাত খুন মামলা হাইকোর্টের বিচারপতি