বিনিয়োগে ‘শর্ত থাকায়’ কালো টাকার প্রভাব নেই পুঁজিবাজারে
২৩ জুলাই ২০২০ ২২:০২
ঢাকা: অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই এবারের বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর আওতায় বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত করা হয় পুঁজিবাজারেও। তবে বাজেট ঘোষণার আগে আর পরের সময়ে পুঁজিবাজারের চিত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দুয়েকদিন সূচক ও লেনদেনে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও সেটি ওই দুয়েকদিনের জন্যই। বাকি দিনগুলোতে টানা দরপতন অব্যাহত থাকছে। অর্থাৎ কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও তার কোনো ইতিবাচক প্রভাবই পুঁজিবাজারে পড়েনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও এর পেছনে যুক্ত করা শর্তের জন্যই এই সুযোগ বাস্তবে কাজে লাগছে না। বাজেটে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ করের পাশাপাশি একবছরের জন্য বিনিয়োগ ‘লক ইন’ থাকবে। অর্থাৎ একবছরের মধ্যে শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকছে। সে কারণেই পুঁজিবাজারে কালো টাকার বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, ব্যাংকে জমা কিংবা জমি ও ফ্ল্যাট কেনা এবং পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করে সাদা বানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত এসব খাতে বিনিয়োগে ১০ শতাংশ কর দিলেই কালো টাকা সাদা হয়ে যাবে। তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করা টাকা পরবর্তী একবছর ‘লক ইন’ রাখার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ করার পর এক বছর শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিতে পারবেন না বিনিয়োগকারী— এমন শর্ত যুক্ত করে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শর্তের কারণেই কালো টাকার মালিকরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগরে সুযোগ দেওয়া হলেও এর কোনো প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়কে না। কারণ পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে ১০ শতাংশ কর দেওয়ার পাশাপাশি একবছর বিনিয়োগ ‘লক ইন’ রাখার কথা বলা হয়েছে। অথচ অন্য যেসব খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে কেবল ১০ শতাংশ কর দিলেই কালো টাকা সাদা হয়ে যাবে। ফলে সহজ সুযোগ ছেড়ে কে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবে?
চলতি অর্থবছরের বাজেট পুঁজিবাজারবান্ধব নয়, বরং বাজেটের কিছু সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে জন্য ক্ষতিকর হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিবর্তে তালিকা বহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। এতে করে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট করের ব্যবধানে ১০ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে সাত শতাংশ করা হয়েছে। এতে করে কোনো ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে না।
বাড়তি শর্তযুক্ত করে বিনিয়োগের সুযোগ দিলেও তা কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমানও। এ ক্ষেত্রে এর আগের উদাহরণও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ১৯৯৭-৯৮ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। দুই বছর বিনিয়োগ রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয়নি। কেউ সেই শর্ত মেনে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেনি। কোথাও কোনো শর্ত দিয়ে কাউকে বিনিয়োগে আনা যাবে না। পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে এ বছরও তাই হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকে টাকা থাকলে মাত্র ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে পুরো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে পুঁজিবাজারে ট্যাক্সের পাশাপাশি এক বছরের জন্য বিনিয়োগ ধরে রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছে। এই শর্ত মেনে কেউ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবে না।
পুঁজিবাজারের লেনদেনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের পর্যবেক্ষণ— কালো টাকার প্রভাব লেনদেনে নেই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও কোনো ইতিবাচক প্রভাব আমরা দেখছি না। কালো টাকা পুঁজিবাজারে এলে লেনদেন আড়াইশ কোটি টাকার নিচে থাকত না। লেনদেন আরও বাড়ত। ফলে বাজারে কালো টাকা ঢুকেছে— এটা আসলে বলা যাচ্ছে না। তিনিও এ ক্ষেত্রে ‘লক ইন’ শর্তকেই প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন।
অন্যদিকে, পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান সরাসরিই সারাবাংলাকে বলছেন, ‘লক ইন’ শর্তের কারণে কেউ পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করতে আসছে না। তাই এই শর্ত তুলে নেওয়া উচিত বলে মত তার। মিজানুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত রাখলে এক বছরের ‘লক ইন’ শর্ত তুলে নেওয়া উচিত। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করের হার যদি ১০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে বিনিযোগ বাড়বে।
‘লক ইন’ শর্ত অধ্যাপক আবু আহমেদ কালো টাকা কালো টাকা বিনিয়োগ কালো টাকা সাদা ডিএসই ডিএসই পরিচালক রকিবুর রহমান পুঁজিবাজার বিনিয়োগের সুযোগ স্টক মার্কেট