করোনাকালে বিমানবন্দর উন্নয়ন-নিরাপত্তা ফি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’
২৬ জুলাই ২০২০ ১৯:১৭
ঢাকা: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাব পড়েছে প্রায় সব খাতেই। তবে এই ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ঠেকেছে তলানিতে। কোনো কোনো এয়ারলাইন্স তো নিজেদের ব্যবসাই গুটিয়ে নিয়েছে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে রিজেন্ট এয়ারলাইন্স। অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর অবস্থাও নাজুক। করোনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে এবং যাত্রীর অভাবে সেই যাত্রাও চলছে খুঁড়িয়ে। এর মধ্যেই যাত্রীদের কাছে বিমানবন্দর নিরাপত্তা ফি ও উন্নয়ন ফি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
এয়ারলাইন্সগুলো ও বিমান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার এই সংকটকালে এমনিতেই যাত্রীর সংখ্যা কম। এর ওপর গত ২৩ জুলাই থেকে বিমানযাত্রায় যুক্ত হয়েছে করোনা সার্টিফিকেটের বাড়তি খরচ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী চলাচল করতে গিয়ে প্রতিটি ফ্লাইটেই যাত্রীর সংখ্যা নামিয়ে আনা হয়েছে অর্ধেকে। তাতে করে কিছুটা হলেও বেড়েছে বিমান ভাড়া। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের এই ফি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়াবে। অন্তত করোনাকাল কেটে গেলেও এই ফি আরোপ করলে সেটি ‘যুক্তিসঙ্গত’ হতো বলে মনে করছেন তারা।
গত ২২ জুলাই বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এক আদেশে জানায়, ১ আগস্ট থেকে দেশের বিমানবন্দর ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক রুটে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ রুটে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ১০০ টাকা, যাত্রী নিরাপত্তা ফি ৭০ টাকাসহ মোট ১৭০ টাকা দিতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রুটে ভ্রমণে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি পাঁচ ডলার ও যাত্রী নিরাপত্তা ফি ছয় ডলার, মোট ১১ ডলার (৮৫ টাকা ডলার হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় ৯৩৫ টাকা)। আর সার্কভুক্ত ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ১০ ডলার ও যাত্রী নিরাপত্তা ফি ১০ ডলার হিসাবে মোট দিতে হবে ২০ ডলার (৮৫ টাকা ডলার হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় ১৭০০ টাকা)।
বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে প্রতিবছর কী পরিমাণ যাত্রী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে যাতায়াত করেন, সে বিষয়ে তথ্য দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ। তবে বেবিচকের একটি সূত্র বলছে, গত বছর বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে ৪৫ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ যাত্রী বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে।
সিভিল এভিয়েশনের এই হিসাব বিবেচনায় নিয়ে যদি ২৫ লাখ যাত্রীর সবাই-ই সার্কভুক্ত দেশগুলো গেছেন বলেও ধরে নেওয়া হয়, তাহলে এই যাত্রীদের কাছ থেকে উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ফি বাবদ বেবিচক কর্তৃপক্ষের আয় হবে ২৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে অর্ধেক, অর্থাৎ সাড়ে ১২ লাখ যাত্রী সার্কভুক্ত দেশে এবং বাকি অর্ধেক যাত্রী অন্য দেশগুলোতে গিয়েছেন ধরে নেওয়া হলে, তাহলে কর্তৃপক্ষের আয় হবে ৩২৯ কোটি ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ফি বাবদ বেবিচকের আয় বছরে নেহায়েত কম হবে না।
বাড়তি ফি যাত্রীদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এই সময়ে যাত্রীদের ওপর এমনিতেই চাপ রয়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে যেকোনো ধরনের বাড়তি চার্জ আরোপের অর্থই হলো যাত্রীদের ওপর চাপ তৈরি করা। এতে যাত্রীরা বিমানযাত্রায় নিরুৎসাহিত হবেন। ফলে বিমান খাতে আমাদের যে লোকসান গুনতে হচ্ছে, তা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছি।
নভোএয়ার এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে ভাড়া বাড়ানো উচিত ছিল আমাদের। কিন্তু সিভিল এভিয়েশন আমাদের বলেছিল ভাড়া যেন না বাড়াই। আমরা তাদের কথা রেখেছি। কিন্তু সিভিল এভিয়েশন নিজেই এখন বাড়তি ফি আরোপ করছে। এতে করে যাত্রীদের ওপর চাপ বাড়বে। অন্তত করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পর এই চার্জ আরোপ করলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু আমাদের মনে হয় এই বিষয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন বাংলাদেশ বিমানের অবশ্য এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। বিমানের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, সরকার আদেশ দিয়েছে, আমরা টিকিটের সঙ্গে এটি আদায় করব। এটা নিয়ে আমাদের ভাবার কিছু নেই।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে বেবিচকের এই সিদ্ধান্ত ‘সুবিবেচনাপ্রসূত’ নয়। বিমান বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, এই সময়ে এটা করা নিতান্তই ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়াবে। বিমান তো এখন সীমিত পরিসরে চলছে। সারাবিশ্বের মতো দেশের বিমান খাতের অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। আন্তর্জাতিক রুটের টিকিট কিনতে হচ্ছে অনেক দামে। করোনার জন্য সার্টিফিকেট লাগছে ভ্রমণে। এখানেও বাড়তি খরচ। এর সঙ্গে বিমানবন্দর উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ফি নেওয়াটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। এটা যাত্রীদের কাছে বোঝা হয়ে যাবে। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এটা এখন নেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। তারা করোনার পর এটা নিতে পারত। তখন এত কথা হতো না।
আরেক বিমান বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরীও বলছেন, এই মুহূর্তে এই ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিটা গেলে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যাত্রীদের ওপর যে চাপ পড়বে, তাতে বিমান খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যাত্রী কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকবে।
বেবিচক অবশ্য বলছে, বিশ্বের অনেক দেশেই বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও নিরাপত্তা ফি নেওয়া হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও এই ফি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া তাদের এ সিদ্ধান্ত অনেক পুরেনো, এখন কেবল বাস্তবায়ন হয়েছে।
সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, গত বছর থেকে আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এই চার্জ সরকারের বিভিন্ন দফতরের হাত বদল হয়ে অনুমোদন হয়েছে। করোনার কারণে বরং এটা দেরিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। নইলে আরও আগেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতো।