রাজনীতি মুক্ত বুয়েট, রাজনীতি মুক্তই থাকুক
২৭ জুলাই ২০২০ ২০:২৩
গভীর উদ্বেগের সাথে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও সেই ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত ২৪ জুলাই রাতে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। যতটা না এ কারণে হতচকিত হয়েছি তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছি এটা দেখে যে, এতো বড় একটি ঘটনাও মূল ধারার রাজনৈতিক অঙ্গনে, টকশোতে ও রাজনৈতিক কলামগুলোতে গুরুত্ব পায়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট প্রতিবাদ করলেও সচেতন নাগরিকবৃন্দ, সুশীল সমাজ ও প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের বেশ নিষ্ক্রিয়ই দেখা যাচ্ছে। অথচ বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবীতে সমাজের এই অংশটিই ছিলো সবচেয়ে বেশি সরব ও সক্রিয়।
উল্লেখ্য, আবরার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গত বছরের ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম তার নিজ ক্ষমতাবলে বুয়েটে সব ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে কেউ ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান।
বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের অনুমোদিত ক্লাব ব্যতীত ছাত্রদের অন্য যে কোনো সংগঠনের কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ। এরপর থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়ে যায় বুয়েটে।
আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সে সময় বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা সর্বজনগৃহীত ও প্রশংসিত হলেও রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর ছিলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া। রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার আগে (১২ অক্টোবর, ২০১৯) একটি অনলাইনে (বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর) এ ব্যাপারে দেশের প্রথমসারির রাজনৈতিক দল ও ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃবৃন্দের মতামত সংযুক্ত করে একটি নিউজ প্রকাশ করেছিলো। যেখানে সকলেই বলার চেষ্টা করেছেন, রাজনীতি নিষিদ্ধ কোনো সমাধানের পথ নয়, এখান থেকে আরও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। প্রায় সকলেই শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, রাজনীতি বন্ধের সুযোগে যেনো কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি সুযোগ নিতে না পারে। এ তালিকায় নীরব ছিলেন শুধুমাত্র বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্যও করেননি, বরং পরবর্তীতে এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আর কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। সে ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২৪ জুলাই রাতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। যা সম্পূর্ণই অগ্রহণযোগ্য, অগণতান্ত্রিক ও হঠকারী একটি সিদ্ধান্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ছাত্রদল তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, রাজনৈতিকভাবে কোনো লাভবান হয়নি।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, ‘বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তটি ছিল একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত৷ বুয়েট কর্তৃপক্ষের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আমরা মানি না৷’
বুয়েটে কমিটি দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই কমিটি দিয়েছি। এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।’
অথচ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি ছিলো হাজার-হাজার শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের দাবী। সরকার বা বুয়েট প্রশাসনের একক সিদ্ধান্ত ছিল না। ছাত্রদল গণতন্ত্রের কথা বলে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা দাবী করে। অথচ বুয়েটের শতকরা ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর দাবীকে তারা মানে না, অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত বলে মনে করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও আইন ভঙ্গ করে কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে তারা যে অপরাধ করেছে তার জন্য ভুল স্বীকার না করে আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত রাখার মতো দাম্ভিকতা করে চলেছে। যা সত্যিই দুঃখজনক।
১২-১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও যারা এতোটা বেপরোয়া হতে পারে ক্ষমতায় আরোহণের পর তাদের আচরণ কেমন হবে তা ভাবার বিষয়।
ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘বুয়েটের ঘটনায় যে সংগঠন দায়ী সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ না করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রদল এ সিদ্ধান্তকে কখনোই মানেনি।’
তারা যদি কখনোই এ সিদ্ধান্ত না মেনে থাকে তাহলে বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিকভাবেই প্রতিবাদ করা প্রয়োজন ছিল তাদের। যা তারা করতে পারেনি। এতে উল্টো তাদেরই রাজনৈতিক অপরিপক্বতার প্রকাশ পায় অথবা না মানার এ বিষয়টিকে মিথ্যা যুক্তি হিসেবে মনে হয়। আর বুয়েট প্রশাসনের সিদ্ধান্ত তাদের মানা বা না মানা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই শিরোধার্য। আর কোনো একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন যদি আসেই তাহলে উল্লেখ্য, ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটের আরেক মেধাবী শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার সনিকে ছাত্রদলই হত্যা করেছিল। যদিও তৎকালীন বিএনপি সরকার এর কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি।
সুতরাং অপরাধে যুক্ত থাকা ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হলে ছাত্রদলকে ১৮ বছর আগেই নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন ছিল।
এসব গেলো রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের তর্ক-বিতর্ক ও হতাশার গল্প। কিন্তু এতসব হতাশার মধ্যেও আশার কথা হলো, এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে বুয়েট প্রশাসন। বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, এটি তাদের জন্য নতুন একটি অভিজ্ঞতা৷ বুয়েটের বিদ্যমান আইন অনুসারে রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বুয়েটের ডিসিপ্লিনারি বোর্ড এ বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কমিটিতে বুয়েটের সাবেক কোনো শিক্ষার্থী থেকে থাকলে তার বা তাদের সনদ বাতিল করারও সুযোগও রয়েছে।
সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর দাবীর মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অবশ্যই যৌক্তিক এবং একইভাবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সেখানে কমিটি ঘোষণা দিয়ে যা করেছে তা নিঃসন্দেহে অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক। তারা নিজেদের ভুল স্বীকার করে রাজনৈতিক লড়াইয়ে এবারের মতো হেরে গিয়েও জিতে যাবে নাকি জিতে গিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হেরে যাবে আপাতত সেটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করছি। আবার এমনও হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নাম মাত্র বিরোধিতা করে নীরবতা পালন করবে, ছাত্রদল জয়ী হবে এবং ধীরে সব ছাত্র সংগঠন আগের মতোই রাজনীতি শুরু করবে। অতঃপর কোনো একদিন আবার আমরা বুয়েটে সবিকুন নাহার সনি বা আবরার ফাহাদের মতো অন্য কারও লাশ দেখতে পাবো! যার জন্য সর্বাংশে দায়ী থাকবে ছাত্রদল ও তাদের আজকের হঠকারী সিদ্ধান্ত।
আমরা চাই, তা যেনো কখনোই না হয়। রাজনীতি মুক্ত বুয়েট, রাজনীতি মুক্তই থাকুক।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজ