প্রধানমন্ত্রী অসম্ভব দক্ষতায় করোনা সংকট মোকাবিলা করছেন— ড. বিজন
২৯ জুলাই ২০২০ ১৪:২১
ড. বিজন কুমার শীল। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) প্রদুর্ভাব শুরু হলে বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে করোনা শনাক্তে র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করে হৈ চৈ ফেলে দেন। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন তার এই র্যাপিড টেস্ট কিট উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি। কিটের মানোন্নয়নে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
করোনাভাইরাস শনাক্তে র্যাপিড টেস্ট কিট আবিষ্কারের আগে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস শনাক্ত করার কিট আবিষ্কার করেছিলেন ড. বিজন। সিঙ্গাপুরের একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে আবিষ্কৃত সেই কিট প্যাটেন্ট করেছে চীন। আর করোনা শনাক্তে তার এবারের আবিষ্কার ‘অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট’ ও ‘অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট’ এখনো ঝুলে আছে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
তবে থেমে যাননি ড. বিজন কুমার শীল। সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র–আরএনএ বায়োটেক লিমিটেডের ল্যাবরেটরিতে ড. ফিরোজ আহমেদ, ড. নিহাদ আদনান, ড. মো. রাইদ জমিরুদ্দিন, ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকারকে সঙ্গে নিয়ে দিন রাত কাজ করছেন। দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যাস্ত থাকেন তিনি। এই ব্যাস্ততার মধ্যেও করোনাভাইরাস নিয়ে নিজের গবেষণালবদ্ধ অভিজ্ঞতার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন সারাবাংলাকে। মোবাইল ফোনে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আসাদ জামান। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে নেওয়া সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।
সারাবাংলা: চীনের উহানে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সাত মাস কেটে গেছে। এখনো সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ভাইরাস। নতুন নতুন দেশ ও জনপদ আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজার হাজার লোক। করোনাভাইরাসের এই দাপট কবে নাগাদ শেষ হতে পারে?
ড. বিজন কুমার শীল: পৃথিবীতে আসা মহামারিগুলোর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খুব দ্রুত এটা যায় না। আবার সারাজীবন থেকে যাবে— বিষয়টি সে রকমও নয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটা অবস্থান করে। তারপর আপনি আপনি এর শক্তি কমে যায়। চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখানে এর দাপট কমে এসেছে। এখন ইউরোপ-আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পিক টাইম চলছে। একটা সময় পর এসব অঞ্চলেও এর দাপট কমে যাবে। কিন্তু কমার আগে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেহেতু জনবহুল, সেহেতু এখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ইউরোপ আমেরিকার মতো হলে বিপর্যয় নেমে আসবে।
সারাবাংলা: বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছে সাড়ে তিন মাস আগে। এখন যে হারে মৃত্যু ঘটছে এবং মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য কেমন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে?
ড. বিজন কুমার শীল: আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে পজিটিভ মেসেজ থ্রো করা। কারণ, নেতিবাচক খবর মানুষের মনোবল দুর্বল করে দেয়। আর মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মানুষের পক্ষে মহামারি মোকাবিলা করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ইতিবাচক গল্পটাই মানুষের সামনে ধরা প্রয়োজন।
সারাবাংলা: সেই ইতিবাচক গল্পটা কী?
ড. বিজন কুমার শীল: ক’দিন আগে আমাদের দেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতে ঘূর্ণিঝর আম্পান এলো। সাগরে উৎসস্থল থেকে যে গতিতে ঝড়টি অগ্রসর হচ্ছিল, ওই গতিতেই যদি জনপদ অতিক্রম করত, তাহলে সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত। কিন্তু সুন্দরবনের বাধায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান দুর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেটি থেকে আমরা রক্ষা পাই।
সারাবাংলা: আম্পান ঠেকিয়েছিল সুন্দরবন, করোনাভাইরাস ঠেকাবে কে?
ড. বিজন কুমার শীল: করোনাভাইরাস ঠেকাবে অ্যান্টিবডি। কোনো জনপদে কোনো ভাইরাস আক্রমণ করলে, সেই জনপদের মানুষের মধ্যে আপনাআপনি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও সেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। এই অ্যান্টিবডির প্রতিরোধে করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ভাইরাস মানুষের মধ্যে হয়তো সংক্রমিত হবে, কিন্তু মানুষকে কাবু করতে পারবে না। অ্যান্টিবডির বিরুদ্ধে লড়াই করে ভাইরাস নিজেই শক্তিহীন হয়ে পড়বে।
সারাবাংলা: তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার এত বেশি কেন?
ড. বিজন কুমার শীল: জন্মগতভাবেই ওদের ইমিউনিটি পাওয়ার কম। ওরা রোদ-বৃষ্টি-ঝর, ধূলা-বালির সঙ্গে পরিচিতি নয়। ফলে ভাইরাসটি ওদেরকে দ্রুত কাবু করে ফেলতে পেরেছে। কিন্ত আমরা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকি। আমাদের শরীরে ইমিউনিটি পাওয়ার খুব বেশি। এসব ভাইরাস আমাদের পরাস্ত করতে পারবে না। কিন্তু দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারবে।
সারাবাংলা: আপনারা যে কিট আবিষ্কার করলেন, সেটির রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি এখনো ফায়সালা হলো না। ফায়সালা হওয়ার আগেই যদি করোনা দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে আপনাদের এই কিট কী কাজে আসবে?
ড. বিজন কুমার শীল: আমরা আমাদের কিট নিয়ে ভাবছি না। আজই যদি খবর আসে, বাংলাদেশে একজন করোনা রোগীও নেই, তাহলে আমাদের মতো খুশি আর কেউ হবে না। আমাদের এই আবিষ্কার বাংলাদেশের মানুষকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। সুতরাং মানুষ যদি করোনা থেকে এমনি এমনিই মুক্তি পায়, সেটা আমাদের জন্য আনন্দের খবর। কিন্তু বাস্তবতা হলো— করোনা হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু দ্রুত যাবে না। এখন হয়তো ঢাকায় এর প্রকোপটা বেশি। কিছুদিন পর হয়তো দেখা যাবে ঢাকার বাইরের জেলা বা শহরগুলোতে করোনাটার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। সুতরাং কিটের অনুমোদন যখনই মিলবে, তখনই এটা মানুষের কাজে লাগবে।
সারাবাংলা: বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাস যেভাবে মোকাবিলা করছে, সেটার ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ড. বিজন কুমার শীল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসম্ভব দক্ষতায় করোনা সংকট মোকাবিলা করছেন। পৃথিবীতে যে ক’জন রাষ্ট্রনায়ক সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে করোনা সংকট মোকাবিলা করছেন, তাদের মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্যতম। তার অসামান্য নেতৃত্বের কারণে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি।
সারাবাংলা: আপনাকে তিনি ডেকেছিলেন। তারপর আর যাওয়া হয়নি। কারণটা কী?
ড. বিজন কুমার: তিনি আন্তরিকতার সঙ্গেই আমাকে ডেকেছিলেন। আমিও ভেবেছিলাম কাজ আরেকটু গুছিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। তারপর আর শিডিউল মেলানো যায়নি। তাছাড়া তার সুস্থতা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবে তার সঙ্গে দেখা না হলেও নেপথ্যে থেকে তিনি যে সহযোগিতা করেছেন, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের পুরো টিম তার কাছে কৃতজ্ঞ।
সারাবাংলা: ধন্যবাদ আপনাকে।
ড. বিজন কুমার শীল: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অ্যান্টিবডি করোনা ভাইরাস কিট গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ড. বিজন কুমার শীল বৈশ্বিক মহমারি