খোলা চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে যা লিখেছেন ড. জাফরুল্লাহ
২৯ জুলাই ২০২০ ২৩:০৯
ঢাকা: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি লিখেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ২ হাজার ৬৬৪ শব্দের ওই চিঠিজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আদ্যপান্ত। রয়েছে কিছু পরামর্শ, কিছু দাবি, কিছু আবদার। চিঠির পরতে পরতে একজন নাগরিকের ক্ষোভ, হতাশা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, শ্রদ্ধা শুভকামনাও রয়েছে।
সোমবার (২৭ জুলাই) ওই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডাক গ্রহণ ও বিতরণ শাখায় পৌঁছে দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু। এ খবর অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো সারাবাংলাও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। পাঠকের জন্য চিঠিটি হুবহু প্রকাশ করা হলো আজ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অতীতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এই খোলা চিঠি লিখছি। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কেউ না কেউ আমার এই খোলা চিঠিটি আপনার নজরে আনবেন এবং আমি একটি প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পাবো। প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটাই একজন নাগরিকের আকাঙ্ক্ষা।
পৃথিবীর কোথাও যে নিয়ম নেই
রোগীর হাসপাতালে ভর্তির জন্য কোনো দেশে তাদের প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন লাগে না। কোভিড-১৯ আক্রান্তই হোক অথবা কোভিডমুক্ত অন্য কোনো রোগাক্রান্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত দেন উক্ত হাসপাতালের পরিচালক। কার্যত ডিউটিরত চিকিৎসক, নার্স বা ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার। কিন্তু বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবে কি না তার সিদ্ধান্ত দেন স্বাস্থ্য অধিদফতর, রোগী নিজে বা চিকিৎসক নন। কেন্দ্রিকতার এরূপ নিদর্শন পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। অপূর্ব সিদ্ধান্ত। মারহাবা। কেন্দ্রিকতা দুর্নীতির সহজ বাহন।
হাসপাতাল অনুমোদিত না হওয়ার কারণসমূহ
বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন নেই, এমনকি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের, গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টারেরও। আলাদা আলাদা অনুমোদন মানে আলাদা তদবির ব্যয়, আলাদা দরাদরি। অবশ্যি মধ্যে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দক্ষতা প্রদর্শন মিডিয়ায় আলোড়ন আনন্দ সৃষ্টি করে বটে।
হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এমন নিয়মাবলি করেছে যা পূরণ প্রায় অসম্ভব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্থির করে দেন কয়টি পায়খানা, প্রস্রাবখানা থাকবে, ক’জন ডিপ্লোমা পাস নার্স থাকতে হবে।
চাঁদাবাজির সরকারি নাম লাইসেন্স ফি
প্রত্যেক হাসপাতালের সঙ্গে আলাদা আলাদা ল্যাবরেটরি, আলাদা রোগ নির্ণায়ক বিভাগ, দন্ত বিভাগ, আলাদা রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের লাইসেন্স নিতে হয়।
কেবল লাইসেন্স ফি
কেবল লাইসেন্স ফি জমা দেওয়া যাবে না। পরিবেশ অধিদফতর ও অগ্নিনির্বাপক বিভাগে অনেক টাকা খরচ করে তাদের নিয়ম মেনে উভয় বিভাগের অনুমোদনপত্র সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে জমা দিতে হবে। সামান্য হেরফের থাকলে আবেদনপত্র অগ্রসর হবে না। অধিদফতরে ব্যবস্থা নেওয়া থাকলে এবং অনুমোদন না থাকলেও কেউ বিরক্ত করবে না। তবে দালালের মাধ্যমে যোগাযোগ সচল রাখতে হবে। মাসিকের নিয়মটা মানতে হবে, নিয়মিত মাসোয়ারা জমা দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে নির্ধারিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে হবে। দুর্নীতির নিয়মের সিঁড়িটা মেপে চলতে হবে।
ভবিষ্যতে হয়তবা হাসপাতালের বিভাগের সংখ্যা আরো বাড়বে, যথা- ১. বায়োকেমিস্ট্রি ২. সেরোলজি ৩. ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি ৪. মাইক্রোবায়োলজি ৫. ইমিউনোলজি ৬. হিস্টোপ্যাথলজি এবং আরো কত কী!!
কেবল হাসপাতালের অনুমোদন থাকলে চলবে না, হাসপাতালের প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা অনুমোদন থাকতে হবে। অনুগ্রহ করে সরকারি চাঁদা কত বেড়েছে তা লক্ষ করুন। হয়রানি ও দুর্নীতি একত্রে চলাফেরা করে। একটা উদাহরণ দিই। রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের জন্য অনুমোদন চাইতে হলে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ পরিচালনার জন্য রক্ত পরিসঞ্চালন সংক্রান্ত দুই বছর মেয়াদী একটা ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক থাকতে হবে। বাংলাদেশে ২০০০ এর বেশি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র আছে। উক্ত বিষয়ে দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা প্রাপ্ত চিকিৎসক আছেন ৮০ এর অনধিক। এ বিভাগে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্ততপক্ষে ১০ জন চিকিৎসক অবসর জীবনযাপন করছেন। ৬০ বছরে অধিক বয়সী চিকিৎসকদের চাকরি করার বিধান নেই। চিকিৎসকরা তো বিচারপতি বা সিনিয়র সচিব নন।
রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের জন্য ব্যবসায়িক দিক থেকে আকর্ষণীয় নয় বলে, তরুণ চিকিৎসকরা দুই বছর ব্যয় করে এই উচ্চ বিদ্যা অর্জনে আগ্রহী নন। রক্ত পরিসঞ্চালনে তিন মাসের প্রশিক্ষণ অধ্যয়নই যথেষ্ট। বিগত ২০ বছর যাবৎ আমি বলে আসছি চিকিৎসকদের জন্য তিন মাস মেয়াদি রক্ত পরিসঞ্চালনে সার্টিফিকেট কোর্স এবং ছয় মাস মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স প্রবর্তন করুন। তিন মাসের অতিরিক্ত এই বিভাগে শিক্ষা গ্রহণ বা অধ্যয়নে ব্যয় সময়ের অপচয় মাত্র। সরকার বিষয়টি গ্রহণ করেনি। বিষয়টি অনুধাবনের মতো কর্মকর্তা সরকারে নেই। আয়ের সম্ভাবনাও কম। ফলে চোখ বন্ধ করে দুর্নীতি করা সহজ হয়েছে। অদ্যাপি বাংলাদেশে একটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র বন্ধ হয়নি, তবে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালকে দেওয়া সতর্কপত্রের সংখ্যা বেড়েছে।
সরকারের চাঁদাবাজি তথা লাইসেন্স ফি বাবদ সরকারের আয় বাড়বে, পকেট কাটা যাবে জনগণের, তাদের রক্ষার কিছু থাকবে না। থানার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বিপদ আরও বাড়ে।
ল্যাবরেটরি ও রোগ নির্ণায়ক সেন্টারসমেত হাসপাতাল রেজিস্ট্রেশন ফি বছরে এক লাখ টাকার বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মিউনিসিপ্যাল হোল্ডিং ট্যাক্সও আরেক ধরনের চাঁদাবাজি। হাসপাতাল অনুমোদনের নিয়মাবলি সহজ হওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদফতর কেবল নিশ্চিত করবেন প্রত্যেক হাসপাতালে ও ক্লিনিকে চিকিৎসার গুণগতমান অর্থাৎ ন্যূনতম ইমার্জেন্সি চিকিৎসকের উপস্থিতি এবং চিকিৎসকদের নিয়মিত ব্যবহারের জন্য কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় সচল মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির নিশ্চয়তা যেমন ফ্লো মিটার সমেত একাধিক অক্সিজেন ২ সিলিন্ডার, রক্তে অক্সিজেন মিশ্রণ নির্ধারক পালস অক্সিমিটার, অ্যাম্বু ব্যাগ, নেবুলাইজার, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ও বিভিন্ন পরীক্ষার নির্ণায়ক ডায়াগনস্টিক সেট, ওজন নির্ণায়ক একাধিক মেশিন, একটি ইসিজি ও একটি ডিফিব্রিলেটর মেশিন, মৌলিক রোগ নির্ণায়ক এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি ল্যাবরেটরি এবং রক্ত পরিসঞ্চালন সুবিধা যেন থাকে।
সরকারি অযৌক্তিক অপ্রয়োজনীয় নিয়মাবলির কারণে রিজেন্ট সাহেদ তৈরি হয়েছে ঢাকায় এবং প্রত্যেক শহরে ও উপজেলায় বহু রিজেন্ট সাহেদ, সাহাবউদ্দিন ও ডা. সাবরিনা তৈরি হচ্ছে এবং আরও হবে। গত বছর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ডিপ্লোমা নার্সের নিয়োগ বিজ্ঞাপনে ব্যয় করেছে পাঁচ লাখ টাকার অধিক। সরকারি হাসপাতাল নীতিমালা পূরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন ৫০ জন নার্স। ১০ জন নার্সও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকরির জন্য আবেদন করেনি। সরকারি হাসপাতালে সেবা না দিয়ে ধবধবে ইস্ত্রি করা সাদা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো যায়, সরকারি চাকরিতে সেবা না দিয়ে বেতন পাওয়ার সুবিধা আছে। আপনি বলে দিন, আমাদের কী করণীয়? র্যাবে ধরার আগে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল কি বন্ধ করে দেব? বিগত কয়েক বছরে কয়েকটি সৌজন্যমূলক সতর্কবাণী আমাদের দেওয়া হয়েছে। অনুগ্রহ করে এমন নিয়ম করুন, যা সহজে পালন করে জনসাধারণের কল্যাণ করা যায়। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের দালালদের দ্বারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা মালিকরা যাতে নিয়ম অনুসরণ করতে না পারার অজুহাতে হয়রানির সম্মুখীন না হন তেমন নিয়ম করুন।
প্লাজমা জীবন রক্ষাকারী, কিন্তু তাতে কার কী আসে যায়!!
করোনামুক্ত রোগীর রক্ত থেকে আলাদা ভাবে, প্লাজমা সংগ্রহ করে, করোনা রোগীকে প্লাজমা ট্রান্সফিউজ করালে করোনা রোগীতে প্রায় নতুন জীবন সঞ্চার হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনবার প্লাজমা নিয়ে আমার করোনা থেকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম সহজ হয়েছে। কিন্তু যে সাধারণ গরিব রোগীর জীবন রক্ষার্থে প্লাজমার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি সে দরিদ্র রোগীই প্লাজমা সুবিধা থেকে বেশি বঞ্চিত। কারণ অধিকাংশ ল্যাবরেটরির প্লাজমা তৈরির অনুমোদন নেই। এই নিয়মের অজুহাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্লাজমা দেওয়ার জন্য প্রতিবার ১৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা চার্জ ধরা হয় এবং অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে প্লাজমা প্রাপ্তির সুবিধা নেই। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল পাঁচ হাজার টাকায় রোগীকে আন্তর্জাতিকমানের প্লাজমা সরবরাহ করতে চায়, কিন্তু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অনুমোদন নেই, প্লাজমা উৎপাদনের জন্য রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে নেই উচ্চ ডিগ্রিধারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, আছে একাধিক রক্ত পরিসঞ্চালনে নিবেদিত ডিগ্রি ডিপ্লোমাবিহীন এমবিবিএস পাস চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান। নিয়মের বেড়াজালে পড়ে অদূর ভবিষ্যতে ভারত, ভিয়েতনাম ও চীন থেকে প্লাজমা আমদানি করা হবে ওষুধ হিসেবে, তবে প্লাজমা উৎপাদন করা যাবে না। গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত করোনার এন্টিবডি নির্ণায়ক কিটের অনুমোদন অদ্যাপি পাওয়া যায়নি, নিয়মের বেড়াজালে পড়ে।
সাধারণ বিষয়কে কঠিন অঙ্কে পরিণত করা কি যুক্তিসঙ্গত?
২১ জুলাই ২০২০ দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে যে, নিজ বাড়িতে আলাদা রুমে রেখে অধিকাংশ করোনা রোগীও চিকিৎসা করে সুস্থ করা যায়। বসুন্ধরার কোভিড ২০০০ শয্যার আইসোলেশন হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছে মাত্র ১৭ জন (১% অনধিক), চট্টগ্রাম রেলওয়ে ও গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগী ছিল মাত্র একজন করে।
রোগীর দুর্ভিক্ষ ও রোগীর জন্য হাহাকার বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি
অপরপক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন প্রতারিত হওয়ার সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দরিদ্র রোগীকে সাত দিনের জন্য করোনা চিকিৎসা বাবদ পরিশোধ করতে হয় তিন লাখ টাকার অধিক। রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা, সেবা প্রদানকারীদের বেতন, অক্সিজেন ও ওষুধের মূল্য বাবদ ব্যয় কোনোক্রমে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকার বেশি বিল করার কোনো অঙ্ক নেই, কেবলমাত্র প্রতারণা ছাড়া। সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স হোটেলে থাকা খাওয়া বাবদ প্রতিদিন খরচ হয় দুই হাজার টাকার অধিক এবং চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের কাজ করতে হয় দ্বিতীয় সপ্তাহে দু’দিন মাত্র, অপূর্ব ব্যবস্থাপনা।
হতে পারতো সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ১/৪ অংশ শয্যা কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত এবং চিকিৎসক ও অন্য সব স্বাস্থ্যকর্মীদের মাসিক বেতন অতিরিক্ত করোনা ভাতা ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা, ঠিক যেভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি হলে বিপদ ভাতা পেয়ে থাকেন। যারা করোনা রোগীদের সেবায় ভীত, তাদের দ্রুত চাকরি থেকে অব্যাহতির সুযোগ দিন। চিন্তাভাবনা না করে আজগুবি নতুন নিয়ম চালু করলে ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয় না, অনূর্ধ্ব শত টাকার বালিশ, কয়েক হাজার টাকার পর্দা ইত্যাদি শতগুণ বেশি দামে কেনার সুবিধা হয় মাত্র।
বিভাগীয় বিল ভাউচার পরীক্ষা করে কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি কমাতে পারবেন, না ঠেকাতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রীর মানসিক যাতনা ও সময়ের মূল্যও স্মরণে রাখতে হবে। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির ভাগিদার নন, দুর্নীতির দ্রুত বিচার না করায় তা শরীরেও দুর্নীতির আঁচড় পড়ছে। আপনি পরিচ্ছন্ন হওয়া সত্ত্বেও আপনাকেও একদিন হয়তবা এ জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। স্মরণ রাখবেন, বিচারের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা দুর্নীতির বাহন।
‘সুলভে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবার’ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের
দ্রুত অগ্রসরমান করোনা ধ্বংসযজ্ঞ রোধের জন্য আপনার কামনা দারিদ্র্যমুক্ত সুস্থ বাংলাদেশ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া দেশের দারিদ্র্যের অবসান হবে না। ২০২০-২১ বাজেট প্রণয়নে এই উপলব্ধির প্রমাণ নেই। প্রথমত, বড় শহরগুলোতে সব নাগরিককে জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স এর সঙ্গে নিবন্ধনকরণ এবং একেকটি এলাকাকে একটি বড় সরকারি হাসপাতালের সাথে সংযুক্ত করে রেফারেল পদ্ধতি প্রবর্তন- শুরু হবে রাজধানী ঢাকা দিয়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাজার হাজার টাকার বালিশ পর্দার চোরদের একটা ভালো কাজ করার প্রজেক্ট করার নির্দেশ দিন।
অন্যূন ৫০,০০০ লোক সংখ্যার ইউনিয়নে দু’জন সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত না করতে পারলে সার্বজনীন চিকিৎসাসেবার কথা চিন্তা করা আকাশকুসুম চিন্তা হবে মাত্র।
বাংলাদেশের ৫,০০০ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের ৬ ফুট উচুঁ নিরাপত্তা বেষ্টনী, গভীর নলকূপ ও ইলেকট্রিসিটি সুবিধাসহ চিকিৎসকদের বাসস্থান নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় মৌলিক যন্ত্রপাতির জন্য বাজেটে বরাদ্দ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে ন্যূনতম স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে না। সার্বক্ষণিকভাবে যেসব নবীন চিকিৎসক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে ন্যূনতম দুই বছর অবস্থান করবেন, তারাই তাদের পছন্দ মতো বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় সুবিধা পাবেন, কারো ক্ষেত্রে নিয়মের হেরফের হবে না, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নাতনি হলেও নয়।
মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কবৈষম্য দুর্নীতির অপর সোপান
মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, একটি ক্যান্সার ইলেকট্রিক ব্রাকিথেরাপি মেশিনের আমদানি মূল্য প্রায় এক মিলিয়ন ডলার যার উপর ১% আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয় যা আপেক্ষিক দৃষ্টিতে বেশি নয়। তবে আমদানি শুল্কের অতিরিক্ত ৫% অগ্রিম শুল্ক এবং ৫% অগ্রিম আয়কর এবং ১৫% মূল্য সংযোজন কর আপত্তিজনক। আমদানি শুল্কেও বৈষম্য আছে। আলট্রাসনিক যন্ত্রে শুল্ক ১% কিন্তু কার্ডিয়াক মনিটরের শুল্ক ৫%। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতিতে কেবলমাত্র ১% শুল্ক হতে পারে, তবে অন্য কোনো প্রকার শুল্ক, আয়কর মূল্য সংযোজন কর থাকা উচিত নয়। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি আমদানিতে একাধিক শুল্ক হার ও ট্যাক্স থাকায় দুর্নীতির দ্বার সহজে উন্মুক্ত হয়।
খালি প্রিফিল্ড ইনজেকশন (যা ক্যান্সার ও বিকল কিডনি রোগীদের ইনজেকশন তৈরির জন্য অপরিহার্য) ইউভি কেনুলা, ফিডিং টিউব, ফিস্টুলা নিডলস, মাথার সূক্ষ্ম শিরায় ব্যবহৃত সুই, সাকসন, ক্যাথেটারে শুষ্ক ১০% কিন্তু ইনসুলিন কার্টিজ, শ্রবণ বৃদ্ধি যন্ত্র, হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বৃদ্ধি যন্ত্র, ভালভ পরিবর্তন, ওষুধ যুক্ত বা ওষুধ মুক্ত করোনারি স্টান্ট, পুরো শুল্কমুক্ত অর্থাৎ ০% শুল্কে আমদানি যোগ্য। কিন্তু স্টান্ট প্রয়োগ চার্জ ৫০,০০০ থেকে ১৫০,০০০ টাকা। কারণ কী? দুর্নীতির দ্বারের কোন প্রহরী দায়ী? চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাকি স্টান্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, একক এবং সম্মিলিতভাবে?
ইনফিউশানে ২৫% ইসিজি পেপারে ১০% শুল্ক ভুল সিদ্ধান্ত। কতক এন্টিবায়োটিকের যথা টেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন প্রভৃতির শূন্য (০%) শুল্ক, কিন্তু এন্টিবায়োটিক এজিত্রোমাইসিন, এরিত্রোমাইসিনে শুল্ক ১৫%। আরো উদাহরণ আছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে এবং শুষ্ক কর্মচারীদের হয়রানি থেকে জনসাধারণকে রেহাই দিতে হলে দুর্নীতির প্রত্যেক ছিদ্র বন্ধ করতে হবে। শুল্কের একই হার থাকা যুক্তিসঙ্গত হবে। এনার্জি ড্রিংকস, লবণ, মদ, তামাক, পান, জর্দা প্রভৃতির শুল্ক ২৫% নয় ১০০% হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বিএমআরসি-এর চৈনিক ভ্যাকসিন ট্রায়ালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত
৯০-এর দশকে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না, প্রায় সব আওয়ামী লীগ নেতাই ইঁদুরের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী সাহসের সাথে তার অফিস রুমে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিক্যাল গবেষণা কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান। অতীতে বিএমআরসি এর অনুমোদন ক্রমে আইসিডিডিআরবি বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানির পক্ষে ভ্যাকসিন ট্রায়াল করেছে, আপত্তি ওঠেনি। কিন্তু আজ বাংলাদেশে চৈনিক ভ্যাকসিন ট্রায়ালে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ মেডিক্যাল গবেষণা পরিষদের অধিকার নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হৈ হৈ রব করে বলছে ভ্যাকসিন ট্রায়াল করার জন্য বিএমআরসির অনুমতি দেয়ার অধিকার নেই। বিএমআরসি নম্র স্বরে আপত্তি করেছে, সাহস করে বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী পদত্যাগ না করে নখ, দন্তহীন সিংহের আচরণ প্রদর্শন করছেন।
চীনকে বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিন ট্রায়ালে বিঘ্ন সৃষ্টি করে সরকার অত্যন্ত ভুল কাজ করছে, পুঁজিবাদের চক্রান্তে ভারতের ফাঁদে পা দিয়েছে, ঠিক যে ভুল করেছিল বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার শুরুতে। সীমান্তে বিএসএফ প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। নেপাল সরকার ভারতের বিরুদ্ধে সংসদে আইন পাস করেছে, অথচ বাংলাদেশের ভারতের প্রতি নতজানু ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে চৈনিক করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল যদি স্থগিত হয়ে যায় তবে বুঝতে হবে অদূরভবিষ্যতে আমাদের বোকামির কারণে নতুন ওষুধ তৈরির সক্ষমতা হারাব। কী করে ভাত রান্না করতে হবে, তা শেখার জন্য টেক্সাসের ল্যাবরেটরিতে তাদের গবেষণার নিয়মাবলি অনুসরণের প্রয়োজন নেই। পশ্চিমা পুঁজিবাদী জগতের ফাঁদ থেকে সাবধান। চৈনিক ভ্যাকসিন ট্রায়াল নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হন, তবে চীনের সঙ্গে চুক্তি করে নিন, গবেষণা সফল হলে লাভের ৫০% মালিক হবে বাংলাদেশ।
* স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করণীয়
১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির ওষুধের মূল্য নির্ধারণবিষয়ক নীতিমালা সব ওষুধ কোম্পানিকে অনুসরণে বাধ্য করানো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। বাজারে ওষুধের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী ওষুধ কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত ইনডিকেটিভ প্রাইসিং পদ্ধতি (যা শিয়ালের কাছে মুরগি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়ার সমতুল্য) অনতিবিলম্বে বাতিল করা একটি সৎ রাজনৈতিক সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। রোগ নির্ণয় ও অপারেশন চার্জ এবং আইসিইউ চার্জ স্থির করে দিন। দৈনিক আইসিইউ চার্জ সর্বসাকুল্যে ত্রিশ হাজার টাকার অধিক হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। সরকার নির্ধারিত রোগ নির্ণয় ও অপারেশন চার্জ এবং আইসিইউ চার্জ প্রত্যেক বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অনুসরণ করছে কিনা সেটা দেখাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্ব। অন্য কোনো পুলিশি দায়িত্ব অহেতুক এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় কাম্যও নয়।
‘ব্যক্তি মালিকরা’ লাভ ও সেবা দুটোই ভালো বোঝেন। তাদের দায়িত্ব কি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নেয়া সঠিক হবে? চিকিৎসক কত ভিজিট নেবেন তা স্থির করবেন চিকিৎসক নিজে, সরকার নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে তাদের সম্পর্কে বিদেশিদের চর হিসেবে প্রশ্ন ওঠে। অনুগ্রহ করে বিএমআরসি এর কাজে হস্তক্ষেপ রহিত করুন এবং বাংলাদেশে নিজস্ব পদ্ধতিতে এন্টিবডি, এন্টিজেন কিট উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে দেশের স্বার্থবিরোধী চক্রের অ্যাজেন্টে পরিণত হবেন না।
সুলভে সর্বজনীন চিকিৎসাসেবা প্রাপ্যতার জন্য যা করণীয়
আপনি আমাদের সবার প্রধানমন্ত্রী। আপনি ভারতীয় স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি স্যানডরকে প্রতিজন বিকল কিডনি রোগীকে হেমোডায়ালাইসিস দেয়ার জন্য দুই হাজার ১৯৫ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছেন। কতক সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতালে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিকল কিডনি রোগী ৪০০ টাকায় মাত্র একবার হেমোডায়ালাইসিস পেয়ে থাকেন, এ সুবিধা পাওয়ার জন্য অন্য খরচের তদবির আছে। যা হাজার টাকার কম নয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হেমোডায়ালাইসিস সেন্টার হচ্ছে ‘গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার’ যেখানে নাম মাত্র খরচে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জন বিকল কিডনি রোগী হেমোডায়ালাইসিস পেয়ে থাকেন। আপনি ভারতীয় কোম্পানি স্যানডরকে প্রতি বিকল কিডনি রোগীর হেমোডায়ালাইসিসে দুই হাজার ১৯৫ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছেন, অথচ বারবার আবেদন করার পরও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের রোগীদের ৯০০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছেন না।
নিজের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কারণ জানতে চাওয়া কি অন্যায় হবে? কিংবা বেয়াদবি হবে? কারণ জানতে চাওয়া ও প্রতিকার কামনা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে একজন বোকা মুক্তিযোদ্ধার কামনা
দেশের উন্নয়নের জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী আপনি কঠিন পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু লক্ষ্য থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছেন, সঙ্গে বাড়ছে আপনার একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা। দেশের এই কঠিন সময়ে আপনার নিজ দলের পুরনো সহকর্মী এবং অন্য সব রাজনীতিবিদকে সঙ্গে নিয়ে আপনাকে অগ্রসর হতে হবে। তাদের নিশ্চিত করতে হবে সুশাসনের লক্ষ্যে আগামী নির্বাচন হবে সুষ্ঠু পরিচ্ছন্ন নির্বাচন। কোনো চালাকির নির্বাচন নয়, দিনের নির্বাচন রাতে নয়। হয়তবা সফলতা আপনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
ঈদের দিন সময় করে সুস্বাস্থ্য কামনা করতে খালেদা জিয়ার বাসস্থানে যান, এতে দেশবাসী খুশি হবে এবং বঙ্গবন্ধু হেসে বলবেন, ‘ভালো করেছিস, মা’।
আগামী মাসে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধা নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সুবিধাসমেত করোনা সাধারণ ওয়ার্ড চালু করবে ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। রোগীদের সর্বসাকুল্যে দৈনিক খরচ পড়বে তিন হাজার টাকার অনধিক। আপনি কি এই অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাসমেত জেনারেল ওয়ার্ডের উদ্বোধন করবেন?
সুস্থ থাকুন, আমলা ও গোয়েন্দাদের থেকে সাবধানে থাকুন, রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে ডেকে নিন।
ঈদের শুভেচ্ছান্তে
জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।