করোনাকালে কেমন আছেন সিনিয়র সিটিজেনরা?
১ আগস্ট ২০২০ ০৮:২০
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে বিশ্ব পরিস্থিতি। সব শ্রেণি-পেশা এবং সব বয়সী মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষগুলো একেবারেই ঘরবন্দি। কারণ, করোনায় বয়স্কদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও আমলা কারোনার মৃত্যু মিছিলে যোগ দিয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আলোচিত-আলোকিত সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে দুশ্চিন্তা ও কৌতূহল— দুটোয় বাড়ছে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। বিশেষ করে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও যেসব রাজনীতিক সারাবছর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন, তাদের সবাই এখন হোম কোয়ারেনটাইনে।
বছর দেড়েক আগেও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই জোটে বিভক্ত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ও যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি চৌধুরী), সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সংবিধান প্রণেতা, গণফোরামের সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক, সাবেক মন্ত্রী, ডাকসুর ভিপি, জেএসডির সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা আ স ম আব্দুর রব, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাবেক নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম।
শুধু জাতীয় নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরেও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে এসব সিনিয়র সিটিজেন অনেক তরুণদের চেয়ে এগিয়ে থাকতেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ডিসেম্বর মাসেও রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন তারা। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও নানা অনুষ্ঠানে দেখা গেছে তাদের। কিন্তু গত আট মার্চ নভেল করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশের পর এসব সিনিয়র সিটিজেন আছেন হোম কোয়ারেনটাইনে।
এদিকে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও নিজ নিজ পেশায় অসামান্য অবদান রেখে সিভিল সোসাইটিতে সবার কাছে পূজনীয় ব্যক্তি হিসেবে যারা মূল্যায়িত হতেন, সেইসব সিনিয়র সিটিজেনও করোনাকালে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক, সাবেক সেনা প্রধান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান অন্যতম।
কেমন আছেন এই সব সিনিয়র সিটিজেন?— সারাবাংলার পক্ষ থেকে সেটিই জানার চেষ্টা করা হয়েছে। পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো তাদের সর্বশেষ অবস্থা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ৮৮ বছর বয়সী অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি. চৌধুরী) বারিধারার ডিপ্লোম্যাটিক জোনের ১২ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসা ‘মায়া বি’-তে অবস্থান করছেন। নিকটজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিক সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী এখন পর্যন্ত সুস্থ আছেন। দেশের প্রখ্যাত এই চিকিৎসকের দিন কাটছে বই পড়ে, টিভি দেখে এবং প্রার্থনা করে। পরিবার পরিজনের সঙ্গে ভালোই আছেন তিনি।
দেশের প্রবীণ আইনজীব ৮৫ বছর বয়সী ব্যারিস্টার রফিক উল হক ২০০৬-০৮ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করে ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে পরিচিতি পান। সেই থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাকে সামনের সারিতে দেখা যেত। কিন্তু বার্ধক্যজনিত নানা রোগ-ব্যধির কারণে গত কয়েক বছর তিনি নিষ্ক্রিয়। পল্টনের বাসাতেই তার অবস্থান। নিকটজনের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানা গেছে, তিনি মোটামুটি সুস্থ আছেন, ভালো আছেন।
বর্ষীয়ান রাজনীতিক, প্রবীণ আইনজীবী ৮৩ বছর বয়সীয় ড. কামাল হোসেন করোনা সংকট শুরুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নিজের আইন ব্যবসায় সক্রিয় ছিলেন। সংকট শুরুর পর বেইলি রোডের বাসায় হোম কোয়ারেনটাইন করছেন। প্রথম দিকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজ বাসা থেকে ভার্চুয়াল সভা-সেমিনারে যুক্ত হলেও এখন হচ্ছেন না। তবে নিকটজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তিনিও মোটামুটি সুস্থ আছেন, নিরাপদ আছেন। বই পড়া, টিভি দেখা আর লেখালেখির মধ্য দিয়ে তার দিন কাটছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী, বর্ষীয়ান রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন গত নির্বাচনেও মুন্সীগঞ্জের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ৮১ বছর বয়সী এই রাজনীতিক মাঠের রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় না থাকলেও মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত। ক্ষুরধার বক্তব্যের কারণেই তরুণ রাজনীতিকদের আগ্রহের জায়গায় থাকতেন তিনি। তাই শারীরে কুলিয়ে উঠতে না পারলেও মনের জোরে তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে থাকতে হতো। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস এই বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। এখন তিনি গুলশানের নিজ বাসায় অবস্থান করছেন।
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহচর যুবদল নেতা এইচ এম সাইফ আলী খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনি (শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন) সুস্থ আছেন। ভালো আছেন। এই মহামারির মধ্যে গুলশানের নিজ বাসায় বই পড়ে, টিভি দেখে এবং লেখা-লেখি করে তার সময় কাটছে।’
সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান করোনা আসার আগেই গত বছর ৫ নভেম্বর রাজনীতিকে বিদায় জানান। সেদিন থেকেই ঢাকার বনানী ডিওএইচএসের বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। আশি বছর বয়সী মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমি ভালো আছি। বয়স হয়েছে। সে কারণে বাইরে কমই যাওয়া হতো। কারোনা আসার পর সেটা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও সুস্থ আছি, বেঁচে আছি— এটাই বড় কথা।’
অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। করোনা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মার্চ থেকেই মাঠে ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নিজের প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিটের স্বীকৃতি আদায়, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তার করোনাকাল। অতঃপর ২৪ মে তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তবে করোনাকে পরাজিত করে এখন তিনি সুস্থ। করোনা ও নিউমনিয়ার চিকিৎসা শেষে টানা ৬৬ দিন পর বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) বাসায় ফিরেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি এবার বাসাতেই পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করবেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এর সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের বয়স এখন ৭৫ বছর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম এই সংগঠক গত ফেব্রুয়ারিতেও সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন। কিন্তু করোনা আসার পর বাসা থেকে আর বের হননি। উত্তরার বাসাতেই অবস্থান করছেন তিনি। সম্প্রতি সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় তার। কেমন আছেন?— জিজ্ঞেস করতেই এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আগে বল তুমি কেমন আছ? তোমার বউ-বাচ্চা কেমন আছে? আমরা অনেক বেঁচেছি। এখন আমাদের চলে যাওয়ার সময়। চলে গেলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু তোমাদের বেঁচে থাকতে হবে। দেশ তোমাদের হাতে রেখে আমরা চলে যেতে চাই।’
‘এই মহামারির মধ্যে এখন পর্যন্ত ভালো আছি। বাসাতেই আছি। আমার জন্য দোয়া কর। তোমাদের জন্যও দোয়া করি। মহামারি গেলে আবার দেখা হবে’— বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা সর্ব প্রথম উত্তোলনকারী আ স ম আবদুর রব।
দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে নেতাদের রাজপথের ব্যস্ততা বাড়ে! বিশেষ করে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা থাকেন, তাদের ব্যস্ততা অন্যদের চেয়ে বেশি! প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৯ সালে রাজনীতিতে আসা বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তার ব্যতিক্রম নন। ৭৪ বছর বয়সী সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনাকাল শুরুর আগের দিন পর্যন্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন তাকে মাঠের কর্মসূচিতে পাওয়া যেত। তবে করোনা আসার পর তিনি এখন ঘরবন্দি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক এই চেয়ারম্যান সম্প্রতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যাদের বয়স এক শ’ বছরের নিচে, তারা এমন প্যানডামিক দেখেনি। ১৯২০ সালে স্পেনিস ফ্লু এসেছিল। সেবার সারাপৃথিবীতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু সেটির ধরন এ রকম ছিল না। এবারের মহামারি একেবারেই ভিন্ন। সবাইকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। বয়স্কদের জন্য এই ভাইরাসটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ঘরেই আছি। ভালো আছি।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সমর নায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। ৭৩ বছর বয়সী মুক্তিযুদ্ধের এই কিংবদন্তি রাজধানীর মোহম্মপুরের বাসাতেই আছেন। নিজ এলাকার আর্তপীড়িত মানুষের খোঁজ-খবর, বই পড়া, প্রার্থনা, টিভি দেখা আর লেখালেখির মধ্য দিয়ে কাটছে তার করোনাকাল। ঘরবন্দি জীবনে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক শারীরিকভাবে সুস্থ রয়েছেন বলে জানা গেছে তার নিকটজনদের সঙ্গে কথা বলে।