কোরবানির পশুর সঙ্গে ঘরবন্দি শিশুদের আনন্দঘন ঈদ
১ আগস্ট ২০২০ ১৩:২৫
ঢাকা: মায়ের সঙ্গে নানা ভাইয়ের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে পিতৃহীন এশা। পড়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। মা শান্তিবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মেয়েকে খুব একটা বেশি সময় দেওয়া বা মেয়ের খুব বেশি আবদার পূরণ করার সম্ভব হয়ে ওঠে না তার পক্ষে। নানা সেলিম ভূঁইয়াই পরম স্নেহে, আদর-যত্নে লালন পালন করছেন পিতৃহীন এশাকে। এশার সব আবদার ওই নানা ভাইয়ের কাছেই।
বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসের স্কুল বন্ধ। বাইরে যাওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। ফলে ১১ বছর বয়সী এশার দিন কাটে নানা ভাইয়ের সঙ্গে গল্প-গুজব, দুষ্টুমী-খুনসুটিতে। অ্যাপার্টমেন্টের নিচে একটি চেইন ফুড শপ থাকায় মাঝে-মধ্যেই নাতনী বায়না ধরে পছন্দের খাবারের জন্য। মাঝে মাঝে সে বায়না পূরণও করেন সেলিম ভূঁইয়া। তবে গত সোমবারের (২৭ জুলাই) বায়নাটা ছিল অদ্ভূত ধরনের। তার একটা ‘ব্ল্যাক গোট’ চাই, যেটা সে এই ঈদে কোরবানি করবে।
বাসার পাশেই কমলপুর গরু ছাগলের ‘বিরাট’ হাট। কিন্তু তখনো হাট ভালোমতো জমে ওঠেনি। গরু-ছাগল আসেনি খুব একটা। কিন্তু, পিতৃহীন এশার জন্য নানা সেলিম ভূঁইয়া সব করতে প্রস্তুত। বাসার সিকিউরিটি গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে কালো রঙের দুইটা ছাগল কিনে আনেন তিনি। সেদিন থেকেই বাসার গ্যারেজে ছাগলের দরি ধরে দিন কাটছে এশার।
৩০ জুলাই, দুপুর ১ টা। কমলাপুর পশুর হাট। দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কোরবানির পশু কিনতে এসেছেন এক ভদ্রলোক। দুই সন্তানের মধ্যে ছোটটি কন্যা। বয়স পাঁচ কি ছয়! বাবার কেনা ছাগলের পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে সে। কথা বলার কোনো সুযোগ না থাকলেও স্পষ্ট বোঝা গেল, ভদ্রলোকের বাসা হয়তো আশপাশেই হবে। তরপরও এই করোনার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে গরুর হাটে আসায় অনেকেই বাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ওই ভদ্রলোকের দিকে। কিন্তু ওই ভদ্রলোক কতটা নিরুপয় হয়ে এই ঝুঁকিটা নিতে বাধ্য হয়েছেন, সেটা হয়তো ওই ধরনের পরিস্থিতিতে না পড়লে বোঝা যাবে না।
আশিকুল্লাহ আশিক। পেশায় ব্যাংকার। মোহম্মদপুর-বসিলা গরুর হাঁটে দুই পুত্র সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কোরবানির পশু কিনতে গিয়েছিলেন। এদের একজনের বয়স ১০ বছর, আরেকজনের পাঁচ। আশিকুল্লাহ আশিকও করোনাকালে ঘরবন্দি দুই বাচ্চার গরু কিনতে যাওয়ার আবদার উপেক্ষা করতে পারেননি। ছেলেদের মুখে মাস্ক পরিয়ে অস্থায়ী গরুর হাটে নিয়ে যান কোরবানির পশু কিনতে। করোনায় ঘরবিন্দ দুই শিশু সন্তানের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।
এ রকম অসংখ্য বাস্তবচিত্র চোখে পড়েছে গত তিন/চার দিনে। কেউ কোরবানির পশু কিনে এনে বাসার শিশুদের মনে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিয়েছেন, কেউ বা করোনা ঝুঁকিয়ে উপেক্ষা করে প্রিয় শিশু সন্তানকে নিয়ে গরুর হাঁটে ঢুঁ মেরেছেন।
মনোবিদ ও শিশু বিষেজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আনন্দ সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সী মানুষের জন্য হলেও শিশুদের জন্য সেটা ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসে। মূলত, শিশুরাই ঈদের আনন্দ বেশি উপভোগ করে। নতুন জামা-কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, উপহার সামগ্রীর পাশাপাশি বিনোদন স্পটগুলোতে ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, সেটা মূলত শিশুদেরই বেশি পুলকিত করে।
তদুপরি এই মহামারির মধ্যে ঘরবন্দি অবস্থায় থাকতে থাকতে শিশুদের মধ্যে এক ধরনের একঘেয়েমি, মন্দ লাগা, অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সে কারণে ঈদ নিয়ে, ঈদের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তাদের আগ্রহ বেশি, আবেগ, প্রত্যাশা, আনন্দ উদযাপনের স্পৃহা বেশি। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসের কারণে যেহেতু বাচ্চারা খুব একটা বাইরে যেতে পারবে না, সেহেতু এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য কিনে আনা পশুটিই হয়ে উঠেছে শিশুদের আনন্দের উৎস। অব্যশ অতীতেও যে এটি কম ছিল, তা নয়। তবে এবার এর মাত্রাটা একটু বেশি দেখা গেছে। কারণ, দীর্ঘদিন ঘরবন্দি শিশুরা কোরবানির গরু-ছাগল নিজেদের বন্ধুর মতো করেই গ্রহণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে মনোবিদ আনোয়ারা সৈয়দ হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে নগরজীবনে বন্দি শিশুরা এ বিষয়টি নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়। এবারের প্রেক্ষাপটে এটি আরও তীব্র হওয়ার কথা। কারণ দীর্ঘ সময় বন্দি থাকা বাচ্চারা মানসিক রিক্রিয়েশনের জন্য কোরবানির পশুকে একটি উপকরণ হিসেবে নিয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। বাচ্চারা কোরবানি পশুর খুব কাছে ঘেঁষলে নানা ধরনের রোগ-ব্যধি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর করোনা ঝুঁকি তো রয়েছেই।’