‘কারসাজিতে’ এবারও চামড়া ফেলতে হয়েছে সড়কে, নষ্ট ১৫ হাজার
২ আগস্ট ২০২০ ১৯:০১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আড়তদারের কাছে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে এসে আশানুরূপ সাড়া পাননি অনেকে। অভিযোগ উঠেছে, আড়তদারেরা উপজেলা থেকে আসা চামড়াগুলো কিনতে প্রথমে অনীহা দেখান এবং পরে অস্বাভাবিক কম দামে কিনতে সম্মত হন। কিন্তু লোকসান দিয়ে বিক্রি না করে বিক্রেতারা সেগুলো ফেলে দিয়েই চলে যান। আড়তদারদের দাবি, চামড়াগুলো আড়তে আনতে দেরি হওয়ায় সেগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য তারা কিনতে অনীহা দেখিয়েছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ১৫ হাজার চামড়া রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে কিছু চামড়া পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তুলে আবর্জনাগারে ফেলেছেন।
এর বাইরে কিছু চামড়া একটি ট্যানারির কর্মকর্তারা এসে নিয়ে গেছেন। তবে দাম পাননি উপজেলা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসা সেই বিক্রেতারা।
গত বছরও কোরবানির পশুর প্রায় ১ লাখ চামড়া সড়কে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তখন অভিযোগ উঠেছিল, আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে অস্বাভাবিক কম দামে চামড়ার দর নির্ধারণ করতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে চামড়া কেনা বন্ধ করে দেন। বাধ্য হয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রাস্তায় ফেলে চামড়া নষ্ট করেছিলেন।
গত বছরের অভিজ্ঞতায় চট্টগ্রাম নগরীতে এবার মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দেখা তেমন মেলেনি কাঁচা চামড়ার বাজারে। এর বদলে নগরীতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুদামে নেওয়া পর্যন্ত সবই ছিল আড়তদারদের নিয়ন্ত্রণে। তবে বিভিন্ন উপজেলায় এবারও কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করেন এবং নগরীর আতুরার ডিপোতে কাঁচা চামড়ার গুদামে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে আনেন।
শনিবার (১ আগস্ট) কোরবানির পর মধ্যরাত থেকে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আতুরার ডিপোতে কাঁচা চামড়া আনতে শুরু করেন উপজেলা পর্যায়ের সংগ্রাহকরা। রোববার ভোর পর্যন্ত কাঁচা চামড়া আসে উপজেলা থেকে। জানা গেছে, শুরু থেকেই সমিতিভুক্ত ও সমিতির বাইরে থাকা প্রায় আড়াই’শ আড়তদারের সবাই এসব চামড়া কিনতে অনীহা দেখান। পরে চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে, এমন অজুহাতে তারা প্রতি পিস গরুর চামড়া ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাম নির্ধারণ করেন। ৬০০-৭০০ টাকা দরের বিপরীতে অস্বাভাবিক কম দাম শুনে হতাশ হয়ে পড়েন উপজেলা থেকে আসা সংগ্রহকারীরা। ভোরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলে সড়কে রাখা চামড়াগুলো ভিজে যায়। এরপর আর কেনার আগ্রহ দেখাননি আড়তদারেরা। পরে চামড়াগুলো সেখানে ফেলেই চলে যান তারা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির এডহক কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে চামড়া মোটামুটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু উপজেলা থেকে যেসব ফড়িয়ারা চামড়া সংগ্রহ করেছে, তাদের আমরা বিভিন্নভাবে বলেছিলাম- চামড়া যদি বেচতে হয় রাত ৮টার মধ্যে আনতে হবে। কোরবানির পর ৬-৭ ঘণ্টার বেশি চামড়া ভালো থাকে না। কিন্তু তারা চামড়া এনেছে রাত সাড়ে ৩টার পর। তখন চামড়াগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। নষ্ট চামড়া কিনে আমরা কি করব?’
প্রথমে চামড়া কিনতে অনীহা দেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের আড়তে যে পরিমাণ প্রয়োজন এর বেশি চামড়া তো আমরা কিনতে পারব না। লবণ দেওয়ার বিষয় আছে। মানুষ লাগবে। এত চামড়ায় লবণ দেওয়ার তো লোক নেই।’
তবে মাহবুব আলমই জানিয়েছেন, কোরবানি কম হওয়ায় এবার ১ লাখ পশুর চামড়া কম সংগ্রহ হয়েছে।
আড়তদারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই চামড়া না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন আড়তদারেরা। গতবছর চট্টগ্রাম নগরীতে এই প্রক্রিয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া না কেনায় এবছর বাজারে তাদের দেখা মেলেনি। একইভাবে উপজেলা থেকেও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ‘আউট’ করে আড়তদাররা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান।
এদিকে আড়তের সামনে ফেলে যাওয়া চামড়াগুলো দুপুর দেড়টার দিকে চসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা অপসারণ করতে গেলে বিপত্তি বাঁধে। আড়তদার এবং তাদের প্রতিনিধিরা চামড়াগুলো নিজেদের দাবি করে তাদের সরাতে বাধা দেয়। আড়তদার হাজী মাহমুদ আলীর প্রতিনিধি পরিচয়ে নূর আলী নামে একজনকে চামড়াগুলো আবর্জনার গাড়িতে তুলে নেওয়ার প্রতিবাদ করতে দেখা যায়।
নূর আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গুদামের ভেতরে জায়গা কম হওয়ায় আমাদের রাস্তায়ও চামড়া রাখতে হয়েছে। সিটি করপোরেশন এসে চামড়াগুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতে তো আমাদের লস হবে। চামড়াগুলো তো আমরা টাকা দিয়ে কিনেছি।’
আহ্বায়ক মাহবুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি চৌমুহনীতে ছিলাম। সেখানে সিটি করপোরেশন চামড়া নিয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে দ্রুত যাই। গিয়ে দেখি, কিছু চামড়া সিটি করপোরেশন গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। সেগুলো বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দুপুর দেড়টার দিকে রীফ ল্যাদার ট্যানারির কয়েকজন স্টাফ আমাদের অফিসে আসেন। তারা নষ্ট চামড়াগুলো প্রক্রিয়াজাত করবে বলে নিয়ে গেছে। আমার দেখাতে ৭০০-৮০০ চামড়া হবে। সেগুলোর দাম দেওয়ার জন্য লোক খুঁজে কাউকে পাওয়া যায়নি।’
চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম বলেন, ‘আড়তদারদের গাফেলতির কারণে উপজেলা থেকে আনা কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে। দাম কম দিতে চেয়েছে। সেজন্য অনেকে চামড়া বিক্রি না করে রাস্তায় ফেলে চলে গেছে। আড়তদারদের কেনা কিছু চামড়াও নষ্ট হয়েছে। যেমন- সুন্নিয়া আহম্মদিয়া মাদ্রাসা মাঠে প্রায় ৫ হাজার চামড়া নষ্ট হয়েছে। এভাবে প্রায় ১৫ হাজার চামড়া নষ্ট হয়েছে।’
চট্টগ্রামের আড়তদাররা এবছর চট্টগ্রাম থেকে ৪ লাখ গরু, ১ লাখ ছাগল, ১৫ হাজার মহিষ ও ১৫ হাজার ভেড়ার চামড়া সংগ্রহের টার্গেট করেছিলেন। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কোরবানি কম হওয়ায় ১ লাখ চামড়া কম সংগ্রহ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
মাহবুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরুর চামড়া পেয়েছি ৩ লাখেরও কম। সব মিলিয়ে ৪ লাখের মতো চামড়া আড়তে এসেছে। করোনার কারণে এবার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে।’
আতুরার ডিপোর গুদামগুলোতে শনিবার রাত থেকেই কাঁচা চামড়ায় লবণ দেওয়া শুরু হয়। রোববার দিনভরও কাঁচা চামড়ায় লবণ দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন শ্রমিকরা। এক সপ্তাহ পরে ট্যানারি থেকে প্রতিনিধিরা এসে প্রক্রিয়াজাত করা শুকনো চামড়া যাচাই করবেন। এরপর সেই চামড়া বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আড়তদারেরা।